প্রবন্ধ ৩...
এই মেয়েরা সরে না গেলে রাজনীতি সমৃদ্ধ হত
নীরবে পার হয়ে গেল চট্টগ্রামের অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্ত-র (১৯১৩-৯৫) জন্মশতবর্ষ। যে কল্পনা বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে চেয়ে স্কলারশিপের টাকায় সাইকেল কিনে ভোরবেলায় কারও ঘুম ভাঙার আগেই বেথুন কলেজের কম্পাউন্ডের মধ্যে সাইকেল চালাতেন। প্রতি রবিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে নৌকা চালনোর অভ্যেস করতেন। সূর্য সেনের ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি দলের সদস্য হয়ে বিজ্ঞানের ছাত্রী কল্পনা নিজের পড়ার ঘরে বসে বোমার জন্য তৈরি করতেন গান-কটন। ১৯৩৩ সালের মে মাসে চট্টগ্রামের উপকূলে গহিরা গ্রামে ব্রিটিশ ফৌজের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ধরা পড়ার পর তাঁর শাস্তি হয়। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। সি এফ অ্যান্ড্রুজ, রবীন্দ্রনাথ ও আরও অনেকের চেষ্টায় সেই দ্বীপান্তরের আদেশ স্থগিত হয়। জেল থেকে বেরনোর পর পর চল্লিশের দশকের শুরু থেকে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে ও মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কর্মী হিসেবে কল্পনা মন্বন্তর ও যুদ্ধ-বিধ্বস্ত চট্টগ্রামের সর্বত্র ঘুরতেন ত্রাণের কাজে। ‘পিপলস ওয়ার’ ও ‘স্বাধীনতা’ কাগজের জন্য নিয়মিত পাঠাতেন প্রতিবেদন।
ইতিমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বভারতীয় সম্পাদক পূরণচাঁদ জোশীর সঙ্গে পরিচয়, ১৯৪৩ সালের অগস্টে তাঁদের বিয়ে হয় মুম্বইয়ে। বরপক্ষের হয়ে সই করেন বি টি রণদিভে আর কন্যাপক্ষের হয়ে মুজফ্ফর আহমেদ। বিয়েতে সইসাবুদ হয়ে যাওয়ার পর বিনয় রায় ও গণনাট্য সংঘের অন্যান্য প্রথিতযশা শিল্পীরা গান গেয়েছিলেন। বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ির পাঠানো লাল রেশমি শাড়ি পরেননি কল্পনা। পরে সকলে মিলে সেই শাড়ি কেটে কেটে পার্টি ফ্ল্যাগ তৈরি করেছিলেন। বিয়ের পর তাঁর নিজের জায়গা চট্টগ্রামে ফিরে গিয়ে মানুষের মধ্যে কাজ শুরু করেন কল্পনা। সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে ‘গ্রহণযোগ্য’ করে তুলতে হবে বলে কোনও দিন শাঁখাসিঁদুর পরেননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, কাজের মধ্যে দিয়েই মানুষের মন জয় করে নিতে পারবেন। ১৯৪৬-এ কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়েছিলেন সেখান থেকে। দাঙ্গা ও দেশভাগের সময় সম্প্রীতি ও ত্রাণের কাজে ছিলেন অক্লান্ত।
তার পর স্বাধীনতা। দেশভাগ। কমিউনিস্ট পার্টির লাইন পালটে ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। ১৯৪৮-এ বি টি রণদিভের আমলে পূরণচাঁদ কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কোণঠাসা হলেন। পার্টি থেকে প্রবল চাপ ছিল কল্পনার ওপরে, যাতে তিনি তাঁর ‘রেনেগেড’ বা ‘আদর্শগতভাবে বিচ্যুত’ স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। (গার্গী চক্রবর্তীর লেখা পি সি জোশী: আ বায়োগ্রাফি (ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ২০০৭) বইটি দ্রষ্টব্য।) নতি স্বীকারে অসম্মত হওয়ায় দলের সঙ্গে তাঁর তৈরি হয় সূক্ষ্ম অথচ অনতিক্রম্য দূরত্ব।
এর পর বেদনার্ত কল্পনা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন রাজনীতি থেকে। তিনি স্বামী, দুই ছেলে ও তাঁর ছোট ছোট ভাইবোনদের নিয়ে একটি বড় পরিবারকে পালন করেছেন। সত্তরের দশকে অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত চাকরি করেছেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট-এ। শিখেছিলেন রুশ ও চিনা ভাষা। পরবর্তী কালে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব রাশিয়ান ল্যাঙ্গোয়েজ-এর সম্পাদক হন, শিক্ষকও। সক্রিয় ছিলেন পঞ্চাশের দশকে স্থাপিত ইন্দো-সোভিয়েত কালচারাল সোসাইটি ও ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান উইমেন-এর কার্যকলাপে। এবং, সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও জীবনাচরণে ও বিশ্বাসে আজীবন তিনি থেকে গিয়েছেন কমিউনিস্ট।
কল্পনা দত্তের সূত্রেই একটা কথা মনে হয়। পরাধীন ভারতে সক্রিয় নারীকর্মীরা অনেকেই পরের জীবনে অন্তরালে চলে গিয়েছেন। দুটি দৃষ্টান্ত: শান্তিসুধা ঘোষ (১৯০৭-৯২) ও বীণা দাস ভৌমিক (১৯১১-৮৬)। যুগান্তর দলের কর্মী শান্তিসুধা ১৯৫০ সালে বরিশাল ছেড়ে ভারতে চলে আসার পর ১৯ বছর ধরে গড়ে তুলেছিলেন হুগলি মহিলা মহাবিদ্যালয়। গণিতের অধ্যাপিকা। কলেজে রাজনৈতিক পাঠচক্রের সূচনা করেন। ১৯৭০ সালে অবসর গ্রহণের পর নিজে তদারক করে তৈরি করা বাড়িতে জীবনের শেষ বাইশটা বছর কাটিয়েছিলেন এক বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে।
গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করতে যাওয়া ২১ বছরের বীণা দাস ৭৫ বছর বয়সে একাই পাড়ি দিয়েছিলেন হিমালয়ের পথে। সে পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। স্বাধীনতার সময়ে তিনি ছিলেন কংগ্রেসের সদস্য ও বিধায়ক। কিন্তু নেতাদের একাংশের সঙ্গে আদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে অচিরেই সরিয়ে নেন নিজেকে। আত্মনিয়োগ করেন উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজে। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়েও অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন ত্রাণ শিবির সংগঠনে। সারা জীবন দেশেররাজনীতি নিয়ে ভেবেছেন, ছাত্রীদের মধ্যে চারিয়ে দিতে চেয়েছেন রাজনীতির বোধ।
এঁরা প্রত্যেকেই হয়তো আদর্শগত বা ব্যক্তিগত কারণে সরে দাঁড়িয়েছেন সক্রিয় রাজনীতি থেকে। কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার পর তাঁরা দেশের কাজ থেকে সরে গিয়ে নিস্তরঙ্গ জীবন কাটাননি। বরং কর্মক্ষেত্রে এবং জীবনচর্যায় ছোট ছোট আপাততুচ্ছ প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে আজীবন নিজের নিজের বিপ্লব চালিয়ে গিয়েছেন। রাজনীতির বর্হিজগতে তাঁদের অনুপস্থিতি মানেই আমরা যেন ধরে না নিই যে, প্রাত্যহিক জীবনধারণের খুঁটিনাটি গ্রাস করে নিয়েছিল তাঁদের বিপ্লবী সত্তা। আমাদের ভাবতে হবে, কী ভাবে খুঁজব এঁদের জীবনের আপাত-অরাজনৈতিক পর্বে সংঘাত ও প্রতিরোধের নিহিত চিহ্নগুলো।
তার পরেও একটা প্রশ্ন ওঠে। এই অসামান্য মেয়েরা যদি নিজস্ব নিভৃতে সরে না যেতেন, রাজনীতির দুনিয়া তাঁদের সক্রিয় ভূমিকায় সমৃদ্ধ হত না কি? তাঁরা তো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতিনির্ধারকের ভূমিকায় থাকতে পারতেন স্বাধীন ভারতের প্রথম পঁচিশ-তিরিশ বছরে। থাকলে হয়তো লিঙ্গ-সমতার প্রশ্নটি গুরুত্ব পেত দলগুলোর কর্মসূচি ও দাবি-সনদে। কথাটা আজও বাসী হয়ে যায়নি। আজও প্রায় সব দলই ধরে নেয় তাদের মহিলা শাখা-সমিতিগুলোই কেবল মেয়েদের মধ্যে এ সব বিষয়ে প্রচার চালাবে। ফলে যোগ্য মহিলা কর্মীদের রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় হওয়ার বাধাগুলো সামগ্রিক ভাবে দলের মধ্যে গুরুত্ব পায় না। পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যকে জলখাবারে রুটির বদলে পান্তাভাত দেওয়ার অপরাধে স্বামীর হাতে খুন হতে হয়। কল্পনার শতবর্ষে তাই পুরনো প্রশ্নগুলি নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন আছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.