এক দল মেতেছে ধুনুচি নাচে, অন্য দল ঢোল-কাঁসির যুগলবন্দিতে মত্ত। সন্ধ্যা আরতির প্রদীপের আলোয় দেবীর মুখে সে এক অপূর্ব ছটা। পুজোর আনন্দে সকলেই যখন মশগুল, আচমকাই বন্দুকের শব্দ। চোখের সামনেই পরিবারের অন্য সদস্যদের সামনে লুটিয়ে পড়লেন তিনজন। আনন্দের অনুষ্ঠান ভাসল চোখের জলে। নবমীতেই দেবী বিসর্জনের বিষাদে ভরে গেল হিঙ্গলগঞ্জের হালদার বাড়ি।
উত্তর ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম দুলদুলি। সাহেবখালি ও কালিন্দী নদী একাকার হয়ে গিয়েছে এখানে। গ্রামে বর্ধিষ্ণু পরিবার হিসাবে হালদারদের যথেষ্ট নামডাক ছিল। গ্রামের নানা উন্নতির কাজও হয়েছিল তাঁদের হাত ধরে। গড়ে উঠেছিল স্কুল, রাস্তা, ছাত্রীদের জন্য হস্টেল। আজও সে সব কথা এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। চারদিক প্রাচীর ঘেরা দালানকোঠা। সেই দালানেই আশি বছর আগে দেবনারায়ণ হালদার ও তাঁর ভাইয়েরা মিলে শুরু করেছিলেন দুর্গাপুজো। সেই সময় দুলদুলির সেটাই ছিল একমাত্র পুজো।
ভালই চলছিল সব। সে বার একটা জমি নিয়ে বিবাদ শুরু হয় পরিবারের পাঁচ শরিকের মধ্যে। বিরোধ ক্রমশ বাড়তেই থাকে। তারই মধ্যে এসে পড়ে পুজো। তারপর নবমীর দিন আচমকাই ঘটে যায় ওই দুর্ঘটনা। পুজোর আঙিনাতেই বন্দুকের গুলিতে লুটিয়ে পড়ে তিনটি দেহ। এক পক্ষের ছোড়া গুলি প্রাণ কেড়ে নেয় পর পর দু’জনের। মৃতদের একজনের পুত্র অসিতবরণ হালদারের কথায়, “সেদিন সবে খেতে বসেছি। মা বাবার জন্য ভাত বেড়েছেন। বাবার দেরি দেখে ডাকতে গিয়ে গুলির শব্দ শুনতে পাই। কাছে গিয়ে দেখি বাবা, কাকা ও জেঠা দুর্গামণ্ডপের সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছেন। দ্রুত নৌকা করে তিনজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি বাবা ও জেঠাকে।” নবমীতেই দেবী বিসর্জনের সেই আবহে এর পর পুজো বন্ধ হয়ে যায় হালদার পরিবারে। ইতিমধ্যে সাহেবখালি ও কালিন্দী নদী নিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। স্বজন বিয়োগের ব্যাথায় সময়ের প্রলেপ পড়েছে। পরিবারে শুরু হওয়া পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে সকলেরই মনে ছিল অব্যক্ত বেদনা। অবশেষে ঠিক হয় ফের শুরু হবে পুজো। বছর তিনেক আগে থেকে ফের দেবীর আরাধনা শুরু হয়েছে হালদার পরিবারে। দীর্ঘ বছর পরে ভগ্নপ্রায় হালদারবাড়ি ফের সেজে উঠেছে পুজোর সাজে। মিলেমিশে গিয়েছে সকলে। বর্তমান প্রজন্ম ভুলেছে পূর্বপুরুষের বিবাদ। |