ও বাউল তোর একতারাতে মন খারাপের মেঘ জমেছে।
গানটা ভেসে আসছিল বনগাঁর একটি পুজো মণ্ডপ থেকে। তৃতীয়ার দুপুর। বৃষ্টি, বৃ্ষ্টি এবং বৃ্ষ্টি। চারিদিকে থইথই অবস্থা। পুজো যে দোরগোড়ায় সেটা মণ্ডপগুলিতে শিল্পীদের শেষ মুহূর্তের কাজ আর পোশাকের দোকানে উপচে পড়া ভিড় দেখলে মালুম হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির পানে চোখ মেললে শুধুই আলো-আধাঁরির খেলা। প্রকৃতির এখন ভীষণ ‘মনখারাপ’। নাগাড়ে বৃষ্টি যদি তার একটা প্রমাণ হয়, আর একটা হল কাশফুলের অনুপস্থিতি।
প্রথম ট্রেন দেখার আনন্দে কাশবনের মধ্যে দিয়ে ছুটছে অপু-দুর্গা। ‘পথের পাঁচালি’র এই দৃশ্য চিরকালীন। পাড়ার মাঠের পাশে কাশফুল মাথা তোলা মানেই বাতাসে রটে যেত পুজো আসছে। কাশের সংখ্যা যতই বাড়ত, ততই কমে আসত প্রতীক্ষার দিনগুলো। বনগাঁ মহকুমা-সহ উত্তর ২৪ পরগনার আনাচে কানাচে ফুটে থাকত কাশফুল। কিন্তু এ সব এখন অতীত। এখন পাড়ার মাঠে কাশফুলের বদলে মাথা তুলেছে বহুতল। অন্য জায়গাতেও কাশের সংখ্যাও এখন হাতেগোনা। |
দেশভাগের পর ওপার বাংলা থেকে চলে এসেছিলেন মানিকলাল চক্রবর্তী। বাসা বেঁধেছিলেন বনগাঁর চাঁপাবেড়িয়া এলাকায়। সত্তরোর্দ্ধ বৃদ্ধ পুরনো দিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন। কথায় কথায় এল কাশফুলের কথা। মানিকবাবুর গলায় স্বর উদাস হয়ে গেল। বললেন, “আমার বাড়ি ছিল এখনকার বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। বাড়িতে দুর্গাপুজো হত। শরৎ এলেই মাঠ ভরে যেত কাশফুলে। বন্ধুদের সঙ্গে খেলার জায়গা ছিল কাশবন। এদেশে আসার পরেও দেখেছি কাশ ফুটে থাকত এদিক ওদিক। কিন্তু কয়েক বছর হল কাশের দেখা পাই না।”
প্রায় বাইশ বছর আগে বেহালা থেকে বনগাঁয় গৃহবধূ হয়ে এসেছিলেন কবিতা দাস। স্থানীয় মতিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা কবিতাদেবীর কথায়, “ছোটবেলায় শহরে থাকতাম। তাই কাশফুল দেখিনি। স্বামীর আদিবাড়ি বাগদায়। বিয়ের পর সেখানে দেখতাম পুজো এলেই চারপাশ ভরে উঠত কাশফুলে। মনটা কেমন হয়ে যেত। কিন্তু এখন আর কাশফুল দেখি না।”
কাশফুলের গুচ্ছ দেখে শুধু মন কেমন করা নয়, মন হারিয়েছেনও অনেকে। কাশের বনে ‘গোপন কথাটি’ আর গোপন থাকেনি। অনেক নীরব নয়নকেই সরব করেছে কাশফুলের সৌন্দর্য্য। বনগাঁর অনেক কাশবনই একসময় ছিল প্রেমিক-প্রেমিকার নিভৃত আলাপচারিতার জায়গা। বলছিলেন স্থানীয় এক শিক্ষক।
কেন হারিয়ে যাচ্ছে কাশফুল?
বারাসত-ব্যারাকপুর মহকুমার উপ কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) শান্তিরঞ্জন সরকার জানান, চাষের পরিধি বাড়াই কাশফুল কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। সেচ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এখন প্রায় সব উর্বর জমিতেই কিছু না কিছু চাষ হয়। ফলে কাশফুল ফুটতে পারে না। তাঁর কথায়, “আগে বেশিরভাগ জমিতে একবার চাষ হত কিংবা জমি থাকত পতিত। এখন আর সেটা হয় না।”
কাশফুলের কী অভিমান হয়েছে? বেলা শেষের রাঙা আলোয় একদিন যাদের আশ্রয় সে দিয়েছিল, তাঁরা যে এখন তার খোঁজই রাখে না। ফেসবুক-টুইটারে নিজেকে বদলে ফেলা বাঙালিকে কী ছুঁয়ে যাবে কাশফুলের এই অভিমান! |