দুর্গাপুজো বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঘাসে পড়ে থাকা শিউলিফুল, কাশফুলের সারি, পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। আর কানে বাজে ঢাকের আওয়াজ। সেই আওয়াজেই হয়তো বদল আসতে চলেছে এ বার। কারণ, কাঠের ঢাকের জায়গায় বাজারে এসেছে লোহা বা টিনের তৈরি ঢাক।
বদলটা শুরু হয়েছিল বছর খানেক আগেই। কাঠের ঢাকের বদলে ঢাকিরা পছন্দ করছিলেন টিনের ঢাক। হোগলবেড়িয়া থানার রাজাপুরের ঢাকি দুলাল দাস বলেন, “একটি ভাল কাঠের ঢাক কিনতে দাম পড়ছে প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। সেখানে টিনের ঢাকের দাম খুব বেশি হলে ১২০০ টাকা।” শিকারপুরের ঢাকি গোপাল দাস, সমর দাসরাও বলেন, “প্রতি বছর দুর্গাপুজোতে দিল্লি যাই ঢাক বাজাতে। এতটা পথ যাতায়াতে ভারী ঢাকের থেকে লোহা বা টিনের হালকা ঢাকেই বেশি সুবিধা।” তবে সংযোজন, “কাঠের ঢাকের মতো আওয়াজ টিনের ঢাকে কখনওই পাবেন না।” |
কাঠের ঢাক প্রস্তুতকারক যমশেরপুরের কার্তিক দাসের কথায়, “আমকাঠের গুঁড়ি গিয়ে ভাল ঢাক তৈরি হয়। এই কাঠের একটা ঢাক বিক্রি হত ৫ থেকে ৮ হাজার টাকায়। এখন তো এর থেকে অনেক কম দামে টিনের ঢাক পাওয়া যাচ্ছে।”
টিনের ঢাকের বাড়বাড়ন্তে কেমন রোজগার এখন তাঁর?
বাঁশের ঝুড়ি বানাতে বানাতে কার্তিকবাবুর উত্তর, “আগে প্রতি বছর পুজোর সময় প্রায় ২৫-৩০টা ঢাক তৈরির অর্ডার পেতাম। এ বছর এখনও পর্যন্ত তিনটি ঢাকের অর্ডার পেয়েছি।” ঢাক প্রস্তুতকারক আরবপুরের রতন দাস বলেন, “শহরে তো অনেক আগেই টিনের তৈরি ঢাকের প্রচলন শুরু হয়েছে। এখন আমাদের গ্রামাঞ্চলেও শতকরা ৭০ জন ঢাকি বর্ধমানের কাটোয়া থেকে কম দামে টিনের ঢাক কিনে আনছেন। তাই এ বছর কাজ না পেয়ে বেকার বসে রয়েছি।” |
কিন্তু কাটোয়ার লোহার ঢাক প্রস্তুতকারক উত্তম দাসের গলায় উল্টো সুর। তিনি বলেন, “গত বছর পুজোর সময়ে প্রায় দু’হাজার ঢাক বিক্রি করেছিলাম। এ বছর এখনই সংখ্যাটা ছাড়িয়ে গেছে। আশা করি সেটা তিন হাজার ছাড়াবে।” ঢাকের দাম জানতে চাইলে উত্তমবাবু বলেন, “৫০০ টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ৯শো টাকা পর্যন্ত দামে ঢাক বিক্রি করি।” সঙ্গে জানান, লোহার পাতলা চাদর দিয়ে এই ঢাকের খোল তৈরি করা হয়। আর তার দু’দিকে থাকে চামড়া। ঢাকের আওয়াজের পার্থক্যের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “আমকাঠ অনেক মোটা। তাই আমকাঠের ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে পাতলা টিনের ঢাকের আওয়াজের পার্থক্য তো থাকবেই।”
বিক্রম ঘোষ অবশ্য এই বদলে আশাবাদী। তিনি বলেন, “বিশ্বায়নের যুগে ভারী যন্ত্র নিয়ে দেশ বিদেশে ঘোরা কষ্টদায়ক। পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ড্রাম প্রস্তুতকারক সংস্থাও এখন উন্নত মানের ফাইবার দিয়ে বিভিন্ন ড্রাম তৈরি করছে। তাই ঢাকের ক্ষেত্রেও কী জাতীয় ফাইবার বা উপাদান ব্যবহার করেছেন ঢাক প্রস্তুতকাররা তা দেখতে হবে। উন্নত মানের উপাদার ব্যবহার করলে সেই আওয়াজ শুনতে ভাল বই খারাপ হবে না।” দেবজ্যোতি মিশ্রও এই বদল নিয়ে চিন্তিত নন। বরং তিনি বলেন, “বদলই তো নিয়ম। আগে বাঁশি তো কাঠ ছাড়া তৈরিই হত না। কিন্তু এখন তো মেটালের বাঁশিও ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকের ক্ষেত্রেও সেরকম হলে ক্ষতি নেই। তবে নজর রাখতে হবে, যন্ত্রের উপাদানের সঙ্গে যেন কোনও রকম আপস না করা হয়।” |