কোন রাজ্য কেন্দ্রের কাছ থেকে কত অর্থ পাবে, তা অংশত নির্ভর করবে রঘুরাম
রাজন কমিটির রিপোর্টের ওপর। তাই এই রিপোর্ট তৈরির সময় অত্যন্ত
সতর্ক থাকা উচিত ছিল। রিপোর্টে কিন্তু সেই সতর্কতার প্রমাণ নেই।
বিবেক দেবরায় |
উন্নয়নের দৌড়ে দেশের রাজ্যগুলি কে কোথায় আছে এবং কে কেমন করছে, তা জানার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ করা হয়েছিল। তার কাজ ছিল বিভিন্ন রাজ্যের উন্নয়নের একটা বহুমাত্রিক সূচক (কম্পোজিট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স) তৈরি করা। কিছু দিন আগে সেই কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে। সেটি রঘুরাম রাজন কমিটি রিপোর্ট নামে পরিচিত হয়েছে। কমিটির তৈরি সূচক অনুসারে রাজ্যগুলিকে ক্রমানুসারে সাজানো হয়েছে। এটা নিছক একটা তাত্ত্বিক সমীক্ষা নয়, কারণ এই সূচকের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির মধ্যে কিছু কিছু প্রকল্পের অর্থ বণ্টন করবে। তবে আমি আপাতত সে বিষয়ে আলোচনা করব না, সূচক নিয়েই কথা বলব। তবে আরও এক বার বলা দরকার, রাজ্যে রাজ্যে অর্থ বণ্টনের ক্ষেত্রে এই সূচক ব্যবহার করা হবে, তাই এটি খুব সতর্ক ভাবে তৈরি করা দরকার ছিল।
রাজ্যগুলিকে ক্রমানুসারে সাজানোর জন্য যে কোনও সূচক তৈরি করতে গেলেই কয়েকটা কাজ করতে হয়। এক, কোন কোন বিষয়ের ভিত্তিতে সূচকটি তৈরি হবে, তা ঠিক করা দরকার। অনেক সময় একটা বিষয় নিতে চাইলেও নেওয়া যায় না, কারণ সে সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য নেই। যেমন, পরিবেশ। কিংবা ব্যাধির প্রবণতা। দুই, আয়তন, জনসংখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। তাই রাজ্যে রাজ্যে তুলনার জন্য আয়, বিনিয়োগ ইত্যাদিকে জনসংখ্যা বা আয়তনের অনুপাত হিসেবে দেখার দরকার হয়। তিন, কোন বিষয়কে কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত, সেটা ঠিক করতে হয়। চার, আলাদা আলাদা বিষয়ের ভিত্তিতে তৈরি করা সূচকগুলিকে একসঙ্গে মিলিয়ে একটা সামগ্রিক সূচক তৈরি করার জন্য উপযুক্ত একটা পদ্ধতি স্থির করতে হয়। এর প্রত্যেকটা ব্যাপারই গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনও একটিতে কোনও অদলবদল করলে সামগ্রিক সূচকে তার প্রভাব পড়তে পারে, তার পরিণামে রাজ্যের ক্রমবিন্যাস পালটে যেতে পারে। সেই কারণেই বলেছি, এ ধরনের সূচক তৈরির সময় সতর্ক থাকা আবশ্যক। |
রাজন কমিটি দশ রকমের বিষয় বিবেচনা করে সূচক তৈরি করেছে। সেগুলি হল: (১) আয়, (২) শিক্ষা, (৩) স্বাস্থ্য, (৪) বাড়িতে যে সব সুযোগসুবিধা পাওয়া যায়, যেমন শৌচাগার, পানীয় জল ইত্যাদি, (৫) দারিদ্রের অনুপাত, (৬) মেয়েদের সাক্ষরতার হার, (৭) তফসিলি জাতি ও জনজাতির অনুপাত, (৮) নগরায়ণ, (৯) ব্যাঙ্ক ইত্যাদি আর্থিক পরিকাঠামোর প্রসার এবং (১০) যোগাযোগ ব্যবস্থা। এগুলিই ঠিক ঠিক বিষয় কি না, তা নিয়ে নানা মত থাকতে পারে।
কোনও তালিকাই তর্কাতীত নয়। প্রশ্ন হল, এই বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কেন? রাজ্যে রাজ্যে তুলনার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত এই যে, কিছু সর্বজনীন পণ্য ও পরিষেবা যেন দেশের সর্বত্র সকলের নাগালে আসে। কোনও রাজ্যে যদি পার্বত্য বা অন্য ধরনের দুর্গম অঞ্চলে অনেক মানুষ বাস করেন, কিংবা খুব ছোট ছোট গ্রামের সংখ্যা বেশি হয়, তা হলে এই সব পণ্য ও পরিষেবা সরবরাহের খরচ বেশি হবে। এই ব্যাপারটা কি সূচক নির্ধারণের সময় মাথায় রাখা উচিত নয়? তফসিলি জাতি ও জনজাতির অনুপাত কি স্বতঃই গুরুত্বপূর্ণ, না কি সর্বজনীন পণ্য ও পরিষেবা থেকে তাঁরা বঞ্চিত, এটাই ওই অনুপাতকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ? সে ক্ষেত্রে খেয়াল করা ভাল, কিছু কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, তফসিলি জাতির মানুষ হওয়াটা বঞ্চনার আসল কারণ নয়, অন্য কোনও কারণে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। তফসিলি জনজাতির ক্ষেত্রে সমস্যাটা অন্য গোত্রের, কারণ তাঁরা সাধারণত এমন অঞ্চলে থাকেন, যেখানে পরিকাঠামো খুব দুর্বল।
নানা বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। কোনটা জানা বেশি দরকার মেয়েদের সাক্ষরতার হার, না তাঁদের মধ্যে কর্মীর অনুপাত? আয়ের বদলে সাধারণত ভোগব্যয় মাপা হয়, কারণ সে তথ্য বেশি নির্ভরযোগ্য। কিন্তু মোট ভোগব্যয় নেওয়া ভাল, না ব্যক্তিগত ভোগব্যয়? না কি, খাবারদাবার বাদ দিয়ে অন্য জিনিসের জন্য ভোগব্যয়? রাজস্ব সংগ্রহের কথায় যদি আসি, একটা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ আয়ের অনুপাতে সেই রাজ্যের নিজস্ব কর আদায়ের হার কত, সেটা দেখা দরকার নয় কি? যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমার তো মনে হয়, পাকা রাস্তার প্রসার খুব ভাল সূচক। আথির্ক সম্পদের বাজারের প্রসার যদি মাপতে হয়, শুধু ব্যাঙ্কের কথা কেন ভাবব? ডাকঘর নয় কেন? রাজ্য প্রশাসনের সামর্থ্যের মাপকাঠি হিসেবে পুলিশকর্মীর সংখ্যা কেন দেখা হবে না? আমি এক বারও বলছি না, এটা ঠিক, ওটা ভুল। আমি বলছি, কোন মাপকাঠি কেন ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা খুব ভাল ভাবে বিচার করা দরকার। রাজন কমিটি কি তা করেছে? আমি অন্তত তার কোনও লক্ষণ দেখিনি।
আর একটা ব্যাপার আছে। আয় হল একটা বিশেষ সময়ে আয়ের হিসেব, আর আয়বৃদ্ধি হল একটা পরিবর্তনের হার। যে কোনও বিষয়ের ক্ষেত্রেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের হিসেব নেওয়া যায়, অথবা পরিবর্তনের হারটা ধরা যায়। যেমন শিশুমৃত্যু। আমি কোনও একটা বছরের (বা অন্য কোনও কালপর্বের) শিশুমৃত্যুর অনুপাত বিচার করতে পারি, আবার দুটি সময়ের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার কতটা পালটেছে, সেই হারটা দেখতে পারি। দুটি মাপকাঠিতে বিভিন্ন রাজ্যের ক্রমবিন্যাস আলাদা হতেই পারে। আমার বক্তব্য, কোন বিষয়ে কোন হিসেবটা ব্যবহার করা হবে, সেটা একটা মতামতের প্রশ্ন, সেই মতামতের পিছনে একটা বিশেষ তাত্ত্বিক বা দার্শনিক অবস্থান থাকতে পারে। কিন্তু সেই অবস্থানটা স্পষ্ট করা দরকার। রঘুরাম রাজন সেটা করেননি। প্রসঙ্গত, যে দশটি বিষয় রাজন কমিটি নির্বাচন করেছেন, তার মধ্যে ন’টি কালক্রমে পালটাতে পারে, পালটাবেও। কিন্তু রাজ্যের জনসংখ্যায় তফসিলি জাতি এবং জনজাতির অনুপাত কার্যত অপরিবর্তনীয়, অন্তত অন্যগুলির তুলনায়। একটা রাজ্যে এই অনুপাত যা আছে, আছে, তা নিয়ে বিশেষ কিছু করার নেই।
এ বার আসি তথ্যসূত্রের কথায়। ধরা যাক, শিক্ষা। শিক্ষা সম্পর্কিত তথ্য পরিসংখ্যান নেওয়া হয়েছে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (ন্যাশনাল সাম্পল সার্ভে বা এন এস এস) থেকে। এন এস এস নিয়ে যেটা বলা দরকার তা হল, বড় আকারের নমুনা নিয়ে সমীক্ষা সাধারণত করা হয় পাঁচ বছর অন্তর। রাজ্যের অগ্রগতি মাপার জন্য কি তা হলে পাঁচ বছর অন্তর তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, অন্য উপায় নেই? স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য বার্ষিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় ডি আই এস ই থেকে। এ ছাড়া শিক্ষার কয়েকটি দিক নিয়ে তথ্য পাওয়া যায় জনগণনা থেকেও, তবে সে তথ্য আবার দশ বছর অন্তর হাতে আসে। কিন্তু শুধুমাত্র এন এস এস-এর ওপর নির্ভর করব কেন, সেটা স্পষ্ট নয়। তবে আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছে শিশুমৃত্যুর তথ্য। এটিকেই স্বাস্থ্যের একমাত্র সূচক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমার অবাক হওয়ার কারণ স্বাস্থ্য সমীক্ষার শেষ তথ্য যা পাওয়া যায়, সেটা ২০০৫-০৬ সালের। তা হলে রাজন কমিটির তথ্য-সূত্র কী? খুঁজে দেখলাম, ওঁরা এস আর এস বুলেটিন-এর অক্টোবর ২০১২ সংখ্যা থেকে শিশুমৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়েছেন। তাতে কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু এই বুলেটিনে যে তথ্য দেওয়া হয়, সেটা সমীক্ষালব্ধ পরিসংখ্যান নয়, আনুমানিক হিসেব। অনুমান-নির্ভর তথ্যও নিশ্চয়ই ব্যবহার করা চলে, কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট তৈরি করার সময় আনুমানিক তথ্য ব্যবহার করলে সেটা স্পষ্ট ভাবে বলে দেওয়া উচিত। আমি অন্তত রিপোর্টে কোথাও তেমন কোনও টীকা দেখিনি।
আরও নানা খটকা আছে রাজন কমিটির রিপোর্ট নিয়ে। যেমন, বিভিন্ন রাজ্যের পরিসংখ্যানকে তুলনীয় করে তোলার জন্য সব সময় জনসংখ্যার অনুপাতে হিসেব কষতে হবে, তার কী মানে আছে? অনেক ক্ষেত্রে, যেমন পাকা রাস্তার প্রসার মাপতে চাইলে, ভৌগোলিক আয়তনের অনুপাত অনেক বেশি উপযোগী হতে পারে। আর একটা ব্যাপার উল্লেখ করতে চাই। যে দশটি বিষয়কে বিবেচনা করেছেন ওঁরা, তার প্রত্যেকটিকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। আবার কয়েকটি বিষয়কে কতকগুলি দিক থেকে দেখে একটা সামগ্রিক সূচক নির্ণয় করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে ওই দিকগুলির প্রত্যেকটিকে আবার সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কেন সব কিছু সমান গুরুত্ব পাবে, সেটা আদৌ স্পষ্ট নয়, তার কোনও ব্যাখ্যাও কমিটি দেননি। এবং, এর ফলে নানান গোলমেলে ব্যাপার হয়েছে। একটা উদাহরণ দিই। শিশুমৃত্যুকে আনুপাতিক ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ১০ শতাংশ, কারণ আগেই বলেছি সেটিই স্বাস্থ্যের একমাত্র সূচক হিসেবে নেওয়া হয়েছে; অন্য দিকে পরিবারে বিভিন্ন পরিষেবার সরবরাহ মাপা হয়েছে, পানীয় জল তাদের অন্যতম, ফলে পানীয় জল সরবরাহের গুরুত্ব দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশ। এর কি কোনও যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা আছে?
শেষে আরও এক বার বলব, এ ধরনের রিপোর্ট তৈরি করতে গেলে অনেক বেশি সতর্ক হওয়া উচিত, কারণ কোন রাজ্য কত অর্থ পাবে, তা অংশত এর ওপর নির্ভর করবে।
|
দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ |