পাবনায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসবে। আমরা কি কখনও পালটাব না? লিখছেন
বিকাশ সিংহ |
বাংলাদেশে পাবনা জেলায় রুপুর এলাকায় রাশিয়ার সাহায্যে দু’টি এক হাজার মেগাওয়াটের পারমাণবিক চুল্লির কাজ চালু হল। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন স্থির করে, ২০১৫’র মধ্যে পাঁচশো মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হোক। ২০১২ সালেই পারমাণবিক শক্তির বিল পাশ হয় বাংলাদেশ আইনসভায়। রুপুর পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করার জন্যে চিন, দক্ষিণ কোরিয়াও এসেছিল। ২০০৯ সালে রাশিয়ারই জিত হল দু’টি ১০০০ হাজার মেগাওয়াট রিঅ্যাক্টর তৈরি করে দেবে তারা। ভিত্তিস্থাপনার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পারমাণবিক নিরাপত্তা’র দিকে তীক্ষ্ন নজর রাখা হবে। কাজ শেষ হবে ২০২২-এর মধ্যে। বাংলাদেশে বিদ্যুতের ঘাটতি বিপুল। এই দু’টি চুল্লি হলে বিদ্যুতের চাহিদা অনেকটাই মেটাতে পারা যাবে।
বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্ত অসাধারণ। আমাদের অনেককেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে। পাবনা থেকে পশ্চিমবঙ্গের হরিপুর খুবই কাছে। আশ্চর্য, সেখানেও রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। দু’টি না, কম করে তিনটি ১০০০ মেগাওয়াটের চুল্লি নির্মাণের ব্যাপারে। কিন্তু কিছু দিন আগেই পশ্চিমবঙ্গের শক্তিমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত জোর গলায় ঘোষণা করলেন, হরিপুরে কিছুতেই পারমাণবিক চুল্লি বসানো হবে না। সৌরশক্তিতে আমাদের কলকারখানা চলবে। সৌরশক্তিতে বাড়ির উনুন চলে, আলো জ্বলতে পারে। কিন্তু বড় মাপের শিল্প, কলকারখানা? |
আসলে পশ্চিমবঙ্গে কয়লা জ্বালিয়েই বিদ্যুৎ তৈরি হয়। কিন্তু যে কয়লা জ্বালানো হয়, তাতে ছাই অত্যন্ত বেশি, পাওয়ার স্টেশনগুলি প্রায়ই খারাপ হয়। ভারতীয় রেল বলেছে, ছাই নিয়ে আমাদের রেলগাড়ি আর দেশের এক কোণ থেকে আর এক কোণে পাড়ি দেবে না। ভাল কয়লা আমদানি করতে হয়। তার খরচ ক্রমশই বেড়ে চলেছে। তা ছাড়া, কয়লার জ্বালানি থেকে বায়ু দূষিত হচ্ছে। গ্রিনহাউস এফেক্ট আরও তীব্র হচ্ছে। পরিবেশের বিপদ বাড়ছে।
পাশাপাশি, পারমাণবিক চুল্লি থেকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা একেবারেই কম। আর যদি নিরাপত্তার কথা ভাবা যায়, এটা মনে রাখতে হবে যে, স্বাধীন ভারতে পারমাণবিক নিরাপত্তার রেকর্ড পৃথিবীর মধ্যে সেরা। তা ছাড়া, নিরাপত্তা কি এ ভাবে একা একা নিশ্চিত করা সম্ভব? এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে পারমাণবিক চুল্লির নিরাপত্তা খুবই জরুরি। কোনও কারণে ফুকুশিমার মতো দুর্ঘটনা হলে আমাদের বাংলারও নিস্তার নেই। তা হলে পারমাণবিক চুল্লি বসবে না কেন? আজ তিরিশ বছর ধরে শুনছি পারমাণবিক চুল্লি নিরাপদ নয়। কিন্তু এই পশ্চিমবঙ্গের পাশেই কয়লাখনি ধসে কত লোক মারা গেছে?
পারমাণবিক চুল্লির বিরুদ্ধে আর একটা চেনা যুক্তি: ওই অঞ্চলের লোকজন বিপদে পড়বে। উৎখাত হবে। যখন কোনও বাঁধ তৈরি হয়, জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্যে হাজার হাজার লোক উৎখাত হয়, তখন? আর, উৎখাতই বা হবে কেন? তাদেরও আমাদের যত্ন করে দেখতে হবে। ভাল ভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল তৈরি হবে। যাঁরা মাছ ধরে জীবিকা অর্জন করেন, তাঁদের আরও ভাল জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। এগুলো নিশ্চয়ই জরুরি। কিন্তু ‘হবে না’, ‘চলবে না’ বলে বসে থাকলে তো কিছুই হবে না।
১৯৭৬ সালে দেশে ফিরে এসে চেন্নাইয়ের কাছে মহাবলীপুরমে প্রথম যখন যাই, দেখলাম, কয়েকটি গ্রাম মাত্র সেখানে। মাছ ধরে মানুষ জীবন ধারণ করে। তার পরে সেখানেই গজিয়ে উঠল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। একটার পর একটা চুল্লি, আরও কয়েকটি শীঘ্রই বসবে। মৎস্যজীবীরা বহাল তবিয়তে আছেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে। একটা আশা, আনন্দ, এগিয়ে যাওয়ার পরিবেশ।
বাংলায় কি সত্যিই পরিবর্তন আসবে, না যেমনটি ছিল তেমনটিই থাকবে? আমার খুবই নিরাশ লাগে।
|
ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এ হোমি ভাবা অধ্যাপক |