প্রবন্ধ ১...
না-ভোট নিয়ে কিছু সাংবিধানিক প্রশ্ন
ত ২৭ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়ে বলেছেন, এখন থেকে কোনও ভোটার ভোটের মেশিনে একটা অতিরিক্ত বোতাম টিপে জানাতে পারবেন, যে প্রার্থীদের নাম ওপরে আছে, তাদের কাউকেই তিনি ভোট দিচ্ছেন না। ইংরেজিতে এর একটা নামও হয়েছে, ‘নোটা’। ‘নান অব দি অ্যাবাভ’-এর সংক্ষিপ্ত আকার। বাংলা হতে পারে: ঠগ বাজতে গাঁ উজাড়।
এই রায়কে আইন-আদালতের ভাষায় ‘ল্যান্ডমার্ক’ বলা হয়েছে। আদালতের সেই সব রায়কেই ‘ল্যান্ডমার্ক’ বলা হয়, যে রায়ের ফলে সেই বিশেষ বিষয়টি আর আগের মতো করে দেখা যায় না। বাংলায় ‘দিগদর্শী’ শব্দটি বোধহয় ইংরেজি শব্দটির চাইতে যোগ্যতর।
এই রায়ের ফলে সামনে মাস দুয়েকের ভেতর রাজস্থান, দিল্লি, ছত্তীসগঢ় ও মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে ও মাস নয়েকের ভেতর লোকসভা ভোটে ভোটারদের ভোট মেশিনে এই নতুন চাবি দেওয়া হবে। খবর বেরিয়েছে, নির্বাচন কমিশন ভোট মেশিনে এই নতুন বোতাম বসানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
ভারতের যে ইংরেজি কাগজগুলোকে জাতীয় সংবাদপত্র বলা হয় (কেন, তা দুর্বোধ্য), সেগুলিতে এটাই বোঝা যাচ্ছে, যেন এই রায়ের ফলে ভারতের গণতন্ত্রের ভিত একটু শক্ত হল।
শিল্পী: সুমন চৌধুরী।
কেন শক্ত হল, সেটা অবিশ্যি স্পষ্ট নয়। ভারতে গণতন্ত্রের ভিত্তি যথেষ্ট শক্ত। কম দেশই গণতন্ত্রের ভিতের প্রসারতা ও গভীরতায় ভারতের কাছাকাছি আসতে পারে। পৃথিবীর আর কোনও দেশে আমাদের মতো এত ভোটারই নেই। সেই ভোটারদের মধ্যে চেহারার, ভাষার, খাবারদাবারের, পোশাকআশাকের কোনও মিল নেই। রাজনীতির ভেতরেও অনেক অমিল আছে। এই কোটি-কোটি ভোটারকে লাদাখ-লে থেকে আন্দামান-নিকোবর পর্যন্ত গ্রাম পঞ্চায়েত, মিউনিসিপ্যালিটি, কর্পোরেশন, স্কুল-কলেজের গভর্নিং বডি, নানা ধরনের সমবায় সমিতি, অফিস বা কাজের জায়গার ইউনিয়ন, বিধানসভা, বিধান পরিষদ, লোকসভা, রাজ্যসভায় ভোট দিতে হয়। নানা ধরনের ভোট। কিন্তু প্রত্যক্ষই হোক বা পরোক্ষ, সব ভোটই গোপন। এই গোপনতারও একটিই অর্থ: যিনি ভোট দিচ্ছেন, তিনি সবে আঠারো বছর বয়সের নতুন লায়েকই হোন আর শতাধিক বছরের বহু ভোট-অভিজ্ঞা প্রবীণাই হন, তিনি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন রাষ্ট্র কর্তৃক সাংবিধানিক ভাবে সংরক্ষিত গোপন পদ্ধতিতে।
সুপ্রিম কোর্টের এই না-ভোটের পক্ষে রায় প্রসঙ্গে কাগজে কাগজে খবর বেরিয়েছে, পৃথিবীর আর কোন কোন দেশে এমন না-ভোট আছে। সেই লিস্টিটা বেশ কৌতুককর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ব্রাজিল, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, বাংলাদেশ। এর ভেতর আবার যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজ্য ‘নেভাডা’য় নাকি এক আলাদা আইন আছে।
ওই দেশগুলিতে এই না-ভোটটার সঙ্গে ভোটের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কোনও রকম সম্পর্ক নেই। ভোটার ইচ্ছে করলে অন্য কোনও প্রার্থীর নামও লিখতে পারেন। মিকি মাউস এবং ডোনাল্ড ডাক সবচেয়ে বেশি প্রস্তাবিত নাম। ব্রাজিলে এক বার এক গন্ডারের নাম প্রস্তাবিত হয়েছিল।
সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ব্রাজিল, ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের ভোটার সংখ্যা আমাদের বর্ধমানের দাইহাট মিউনিসিপ্যালিটির সমান হলেও হতে পারে। দাইহাটের কথা মনে এল, কারণ দাইহাট হচ্ছে ভারতের প্রাচীনতম মিউনিসিপ্যালিটি।
এই সব দেশে এই সব আইন আনতে হয়েছে, কারণ ভোটাররা ভোট দিতে আসছিলেন না। ব্রাজিল, বেলজিয়ামে ভোট না দিলে ফাইন করা হয়। ভোটারদের খুশি করতেই এই আইন জারি করা হয় ভোটটা দে, কাউকে দিতে ইচ্ছে না করলে কাউকেই দিস না, তোর কাউকে দিতে ইচ্ছে করলে তার নাম লিখে দে, তবু ভোটের বুথে গিয়ে প্রমাণটা রাখ যে ভোট দিয়েছিস, যাতে ভোট দেওয়ার শতাংশটা বাড়ে। নইলে, আন্তর্জাতিক সব সংস্থার কাছ থেকে সাহায্য অথবা ধার পাওয়া যাবে না, তারা বলবে তোমাদের লোকজন সরকারের দায়িত্ব নিতে নারাজ, ভোটটা দে।
এ ছাড়াও, এই সব দেশের ভোটব্যবস্থা ভারতের মতো স্থায়ী ও পুরনো নয়। ফ্রান্সেরও নয়। ফ্রান্সের সংবিধান দ্য গল বদলে দিয়েছিলেন ও তার ফলে, ভোট পদ্ধতিও বদলে গিয়েছে।
এই কথাগুলো এখন বলা দরকার মনে হচ্ছে। যেন এই না-ভোটের ব্যবস্থা ভারতের গণতন্ত্রের অক্সিজেন বা ভেন্টিলেশন এমন একটা অজ্ঞানতা-নির্ভর হুজুগ তৈরি করা হবে বলে সন্দেহ হচ্ছে। এক জন নির্বাচিত সদস্যের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হবে এই বলে যে আপনার আসনে তো এত জন ভোটার বলেছেন আপনি যোগ্য নন। বিধানসভা এবং লোকসভায় নির্বাচিত সদস্যের ব্যক্তিগত মর্যাদাহানি করে গণতন্ত্র শক্ত হয় না। ভারতের মতো বিশালসংখ্যক ভোটারের রাষ্ট্রে কোনও কোনও সময় দু’চারজন খুনি-ডাকাত-লুটেরাও নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। তাতে এটা প্রমাণ হয় না যে বিধানসভা, লোকসভার মেম্বার মানেই চোর-ডাকাত-লুটেরা। বরং প্রমাণিত হয়, ভারতের গণতন্ত্রের প্রসারক্ষমতা।
চার-পাঁচশো বছরের পুরনো প্রাগিংরেজ রাজবংশের রাজত্বহীন বংশধরেরাও যেমন নির্বাচিত হন, তেমনই চম্বলের ডাকাতও নির্বাচিত হতে পারেন। হয়েওছেন। এক জন লোকসভা সদস্য অন্তত ১৫ লক্ষ ভোটারের বাছাইয়ের ওপর নির্ভরশীল। সেই সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতের সোপর্দ অনুযায়ী তাঁকে ফৌজদারি আসামি হিসেবে চিহ্নিত করা হলে (তিনি তখনও আদালতে দণ্ডিত নন) ১৫ লক্ষ ভারতীয় ভোটারের রাজনৈতিক বাছাইকে অসম্মান করা হয়।
ভারতের গণতন্ত্রের বিকাশ ও জটিলতা কোনও সরল সূত্রে বুঝে ওঠা সম্ভবই নয়।
একটি হিসেব বলছে, আম-আদমির চাইতে এমপি-রাই ফৌজদারিতে সোপর্দ হন বেশি। যেমন, ভারতের জনসংখ্যার প্রতি সাড়ে পাঁচ হাজারে মাত্র এক জন কিডন্যাপিং ও অপহরণের দায়ে অভিযুক্ত হন, আর লোকসভা সদস্যদের প্রতি চুয়ান্ন জনে এক জন। এটি কিন্তু অভিযোগের হিসেব, শাস্তির নয়।
আনুপাতিক তুলনা আমাদের সময় বোধহয় ক্লাস সেভেন-এইটে শেখানো হত, এখন হয়তো ক্লাস সিক্সেই হয়। ভারতের জনসংখ্যা ১২৫ কোটি। আর লোকসভার সদস্যের সংখ্যা, ধরা যাক, সাড়ে পাঁচশো। ৫৫০। এই দুই ঘটনাস্থলের আনুপাতিক তুলনা করতে হলে তো আগে বের করতে হবে ৫৫০ ওই ১২৫ কোটির কত দশমিক অংশ।
এ কথা বলার দরকার ছিল না। আমাদের দেশের শিক্ষার অনগ্রসরতা ও ইংরেজি ভাষায় আধিপত্যের ফলে কী ধরনের বিচার প্রচারিত হয়, তার উদাহরণ হিসেবে কথাটা প্রাসঙ্গিক।
সংবিধান সংশোধন না করে না-ভোটের ব্যবস্থা করা যায় কি না, সে প্রশ্নও অনিবার্য। ভারতে কী ধরনের ভোট ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে, কারা ভোট দিতে পারবেন, এই সব নিয়ে অনেক তর্কবিতর্কের পর গণপরিষদে (কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের প্রক্রিয়া স্বীকৃত হয় ও প্রাপ্তবয়স্কের সীমা নির্ধারিত হয় ২১ বছর। রাজীব গাঁধীর নেতৃত্বে যখন সেটা ১৮ বছরে নামানো হল, তখন সংবিধান সংশোধন করতে হয়নি?
যে ভোট পদ্ধতি আমাদের সংবিধানে গৃহীত হয়েছে, তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মনোনীত প্রার্থীদের ভেতর থেকে ভোটারকে বাছাই করার অধিকার দেওয়া। এই মূল উদ্দেশ্য, সে উদ্দেশ্য নিহিতই থাক আর প্রকাশ্যই থাক, কালক্রমে নিশ্চয়ই বদলাতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট নিশ্চয়ই বলতে পারেন যে তেমন বদল দরকার। কিন্তু তার জন্য সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে যেতে হবে কি না, সে প্রশ্নটাকে তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমন কথা মনে করা অসংগত নয় যে, সাংবিধানিক বেঞ্চের পরামর্শ মতো পার্লামেন্টই একমাত্র সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এর জন্য সংবিধানে কী সংশোধন করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তাঁদের রায়ে এই না-ভোটকে পার্লামেন্টের সদস্যদের কোনও প্রস্তাবে ভোট-না-দেওয়ার অধিকারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই এই তুলনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। পার্লামেন্টে কোনও প্রস্তাবে ভোট থেকে বিরত থাকার অধিকার কী করে সাধারণ নির্বাচনে মনোনীত সমস্ত প্রার্থীকে বর্জন করার তুলনা হতে পারে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.