দু’জনার দুটি পথ আসিয়া কি শেষ পর্যন্ত মিলিল? না কি, এই ঐক্য নেহাত আপতিক এবং সাময়িক? উত্তর এখনও স্পষ্ট নহে, তবে উল্লেখযোগ্য, কিছু দিন আগেই নরেন্দ্র মোদী যে যুক্তিবিন্যাসে প্রতিটি নাগরিকের ভোটদান বাধ্যতামূলক করিবার সপক্ষে জোরদার সওয়াল করিয়াছেন, ঠিক সেই যুক্তিই এ বার লালকৃষ্ণ আডবাণীর মুখেও শোনা গেল। প্রশংসা সহকারে বলিলেন, একমাত্র গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যে বাধ্যতামূলক ভোটের আইন প্রণয়নের চেষ্টা করিয়া যাইতেছেন, কিন্তু দুই বার, ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে বিধানসভায় বিলটি পাশ হওয়া সত্ত্বেও বিরোধীদের আপত্তির প্রাবল্যে রাজ্যপাল তাহা আটকাইয়া দিয়াছেন। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক না-ভোটের সিদ্ধান্তকে জোরালো সমর্থন জানাইয়া দুই জনই বলিয়াছেন যে, গণতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ করিবার জন্য ভোটপত্রে ‘না’ বলিবার অধিকার থাকা অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু তাহা যথেষ্ট নহে। প্রত্যেক নাগরিক যদি ভোট দিতে বাধ্য হন এবং হয় কোনও প্রার্থীর নিজস্ব চিহ্নে নয়তো না-বাচক চিহ্নে ভোট দেন, একমাত্র তাহা হইলেই গণতন্ত্র পূর্ণ হয়। আডবাণী ৩১টি দেশের দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন, যেখানে এই মর্মে আইন রহিয়াছে। ভাল করিয়া পরীক্ষা করিলে অবশ্য দেখা যায়, উহাদের মধ্যে মাত্র গোটা-বারোর ক্ষেত্রেই ইহা যথার্থ ভাবে প্রযোজ্য, বাকিগুলিতে এই বাধ্যতামূলক দায় পালন না করিলে নাগরিকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের কোনও আইনি পরিসর নাই। তবে সংখ্যা এ ক্ষেত্রে গৌণ। মুখ্য প্রশ্ন: কেন ভোটের অধিকার বাধ্যতামূলক করিবার কথা আদৌ উঠিবে?
প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। অধিকার হিসাবে কোনও দায় বা কর্তব্য পালনীয় বলার অর্থ এই নয় যে, সেই দায় পালন করাইবার জন্য নজরদারি আইন থাকিবে এবং সেই দায় পালিত না হইলেই আইন মোতাবেক শাস্তি হইবে। নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক একটি অকথিত কিন্তু স্বেচ্ছাপ্রণোদিত চুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, তাহা আইনি বাধ্যতার বিষয় হইতে পারে না। ভোটদান নাগরিকের কর্তব্য: এই বাক্যের মধ্যে ‘কর্তব্য’ শব্দের অর্থটি নৈতিক, আইনি নহে। আইনের কশাঘাত দ্বারা যে কাজ করাইতে হয়, তাহার মধ্যে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কর্তব্যবোধের সম্ভাবনা স্বভাবতই কম। কোনও বাধ্যতার নিগড়ে ভোটের অধিকারকে বাঁধিবার ভাবনাটিই ব্যক্তি-অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ, অর্থাৎ অ-গণতান্ত্রিক। নাগরিক ব্যক্তি হিসাবে ভোটার কার্ড রাখিবেন কি না, রাখিলে তাহার ব্যবহার করিবেন কি না, সব কিছুর উপরেই যে রাষ্ট্র আইনের কড়া নজর প্রতিষ্ঠা করে, সেই রাষ্ট্র আর যাহাই হউক, গণতান্ত্রিক নহে।
তদুপরি, ব্যবহারিক দিক দিয়াও এই মত গ্রহণযোগ্য নহে। কোন নাগরিক ভোট দিলেন না, তাহা খুঁজিয়া বাহির করিয়া তাঁহাকে শাস্তিদান করা সর্বকর্তৃত্বময় রাষ্ট্রের পক্ষেও বড় সহজ কাজ নহে। মোদী বা আডবাণী যে কথাটি ভুলিয়া যাইতেছেন যে, ভোটাধিকার প্রয়োগ করিয়া না-চিহ্নে ভোট দিয়া এক রকমের নেতিবাচক মত জানানো যায়, আর ভোটাধিকার একেবারেই প্রয়োগ না করিয়া আর এক রকমের নেতিবাচক মত জানানো সম্ভব। এই দুই প্রকারের নেতি-র পরিসরই গণতন্ত্রে রাখা জরুরি। এই দ্বিতীয় গোত্রের নেতি-বাদীদের কী ভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করিতে আগ্রহী বা উদ্বুদ্ধ করা যায়, রাষ্ট্র তাহার চেষ্টা করিতে পারে। কিন্তু সেই চেষ্টায় জবরদস্তির স্থান নাই। ব্যক্তিকেই কেবল সু-নাগরিক হইবার সাধনা করিতে বলিলে চলিবে না, রাষ্ট্রকেও সু-রাষ্ট্র হইবার পথে হাঁটিতে হইবে। |