কংগ্রেস বন্ধু, না শত্রু, সি পি আই এম তাহা আজও স্থির করিতে পারিল না। কংগ্রেসের তীব্র বিরোধিতা করিয়াই কয়েকটি রাজ্যে সি পি আই এমের উত্থান। বস্তুত, যে সকল আঞ্চলিক, প্রাদেশিক বা জাত-ভিত্তিক দল গড়িয়া উঠিয়াছে, রাজ্যশাসনের জনাদেশও অর্জন করিয়াছে, তাহারা কংগ্রেসের অবক্ষয়ের ফলে জাতীয় রাজনীতিতে সৃষ্ট শূন্যতা ভরাট করিতেই উদ্ভূত। উত্তর ভারতে লোহিয়াপন্থীরা, পূর্ব ভারতে জয়প্রকাশ নারায়ণ অনুগামীরা এবং দক্ষিণে ধনী কৃষক ও অনগ্রসর জাতগোষ্ঠীর যে-উত্থান জাতীয় রাজনীতিকে বিভক্ত করিয়াছে, কংগ্রেস-উত্তর রাজনৈতিক তৎপরতাই তাহার মূলে। তিন রাজ্যে বামপন্থীদের, বিশেষত সি পি আই এমের উত্থানও কংগ্রেসের শক্তিক্ষয়ের বিনিময়েই। কংগ্রেস-বিরোধিতার কর্মসূচি রূপায়ণই এই সব দলের লক্ষ্য থাকিয়াছে। কিন্তু ইতিমধ্যে বিজেপির উত্থান অনেক দলেরই রাজনৈতিক সমীকরণ গুলাইয়া দিয়াছে, তাহাদের ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতার দ্বন্দ্বের নিরিখে শত্রু-মিত্র নির্ণয় করিতে হইতেছে। বামপন্থীরা ব্যতিক্রম নহেন।
বামেদের কংগ্রেস-বিরোধিতা প্রাথমিক পর্বে কংগ্রেসকে দুর্বল করিয়া বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের মতো মণ্ডল রাজনীতির কারবারিদের মঞ্চালোকে টানিয়া আনে। ভারতীয় জনতা পার্টি কিন্তু কমণ্ডলুর রাজনীতি দিয়া মণ্ডলায়নে অন্তর্ঘাত করিয়া কংগ্রেস-বিযুক্ত জাতীয় রাজনীতির পরিসরটুকু বহুলাংশে দখল করিয়া লয়। কেরলে হিন্দুত্ববাদীদের সামাজিক শক্তির প্রেক্ষিতে সি পি আই এমের কেরল নেতৃত্ব বরাবরই জনসংঘ তথা বিজেপিকে প্রধান শত্রু গণ্য করিয়া আসিয়াছে। আর পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মতো রাজ্যে যেহেতু কংগ্রেসের সহিত সম্মুখসমর করিয়াই বামেদের অগ্রসর হইতে হইয়াছে, তাই এখানকার নেতারা কংগ্রেসকে প্রধান শত্রু রূপে শনাক্ত করিয়াছেন। জাতীয় স্তরের বাম রাজনীতিতে এই টানাপড়েনই তথাকথিত তৃতীয় ফ্রন্ট বা বাম-গণতান্ত্রিক মোর্চার জন্মের মূলে। প্রচুর কনক্লেভ, বৈঠক, সম্মেলন সত্ত্বেও এই তৃতীয় বিকল্পটি দানা বাঁধে নাই। বরং প্রায়শ দেখা গিয়াছে, নির্বাচনের আগে তৈরি হওয়া তৎপরতা নির্বাচন-উত্তর পর্বে অন্তর্হিত, তৃতীয় ফ্রন্টের অনেক সম্ভাব্য শরিকই হয় কংগ্রেস নতুবা বিজেপির সহিত জোটবদ্ধ হইতে উৎসুক। মাঝখান হইতে বামেরা একা পড়িয়া গিয়াছেন। এক বারই কেবল সি পি আই কেন্দ্রীয় সরকারে শরিক হইয়াছিল, কিন্তু সংখ্যালঘু সেই সরকারও বাহির হইতে কংগ্রেসের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল ছিল। সি পি আই এম কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউ পি এ সরকারকেও বাহির হইতে সমর্থন করিয়াছিল। কিন্তু সেই সমর্থনের লক্ষ্য ছিল সরকারের আর্থিক সংস্কার কর্মসূচির উপর রাশ টানিয়া রাখা।
এখন আবার একটি লোকসভা নির্বাচন আসন্ন হইতেই তৃতীয় ফ্রন্ট, ধর্মনিরপেক্ষ জোট ইত্যাদি বিষয়গুলি নাড়াচাড়া হইতেছে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও ওড়িশার শাসক দলকে লইয়া বামেরা আবার ফ্রন্ট গড়ার কথা ভাবিতেছেন। সেই ফ্রন্ট কংগ্রেসের সমর্থন লইবে, না কি কংগ্রেসকে বাহির হইতে সমর্থন করিবে, তাহা লইয়া মতপার্থক্য বামেদের ভিতরেও কম নাই। কংগ্রেস যে আরও দুর্বল হইবে, তাহার সম্ভাবনা প্রবল। এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদীর সেনাপতিত্বে বিজেপির পুনরুত্থান ঠেকাইতে কংগ্রেসের সহায়তা লওয়া হইবে, না কি তাহাকে সহায়তা দেওয়া হইবে, বিতর্ক তাহা লইয়াই। তৃতীয় ফ্রন্ট যে নিজের জোরে ক্ষমতাসীন হইতে অপারগ, ইহা স্পষ্ট। মুলায়ম সিংহ কেন তৃতীয় ফ্রন্টের ঘুড়ি উড়াইতে শুরু করিয়াছেন, তাহাও বুঝিতে কোনও অসুবিধা নাই। কংগ্রেসকে শত্রু বা মিত্র ভাবা কিংবা তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার প্রয়াস, কোনওটিই এখন আর ভারতীয় বামপন্থার কাছে কোনও তাত্ত্বিক বিষয় নয়, বরং নির্বাচনী কৌশল, ক্ষমতা দখলের সম্ভাব্য সোপান নির্মাণের উপায় অন্বেষণ মাত্র। |