দু’জনেই নাস্তিক। এক জন তাঁর মনের চোখে দেবীকে খুঁজতে থাকেন। আর এক জনের দেখাটাও মনের চোখেই। কিন্তু রসদ খোঁজেন শাস্ত্র-পুরাণের পাতায়। বলেন, “এ তো ঠিক সৃষ্টি নয়। এ হল বিনির্মাণ।” গত ক’বছরের থিমপুজোর আসরে এই দু’জনই মূর্তিমান ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছেন। সব থেকে দামি শিল্পীও বটে। কে বেশি দামি, তা নিয়ে মতান্তর আছে। এ বারের পুজোয় দু’জনেই স্বমহিমায়। প্রথম জন, ভবতোষ সুতার। দ্বিতীয় সনাতন দিন্দা।
ভবতোষ তিন হেভিওয়েট নেতাকে (ফিরহাদ হাকিম, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অতীন ঘোষ) প্রতিযোগিতা-বৈতরণী পার করানোর লড়াই লড়ছেন। দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাই ববির (ফিরহাদ) কাছে কলকাতায় আইফেল টাওয়ার দেখতে চেয়েছিলেন। ভব তখন ফ্রান্সে। ‘ববিদা’র অনুরোধে এক বার আইফেল টাওয়ারটা স্বচক্ষে দেখেনও। চেতলা অগ্রণীর মণ্ডপে এখন ৭০ ফুটি এক তোরণ দেখতে চোখ কপালে উঠবে। থিম-ভাবনার সঙ্গে মিলবে না বলে আইফেল টাওয়ার অবশ্যই নয়। তবে সন্ধের আলোর সাজে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। ওই তল্লাটে বেশ কিছু উঁচু বাড়ি মাথা না-তুললে তোরণ নির্ঘাত রাসবিহারীর মোড় থেকে দেখা যেত।
চেতলার পুজোয় বিশ ফুটি এক ত্রিশূল হাতে সুবিশাল ঠাকুর। শাক্ত-বৈষ্ণব-বৌদ্ধ ভাবনার মোহনা। বস্তারের লোকশিল্পীরা এসে লোহার কারুকাজে মণ্ডপ সাজিয়েছেন। পেল্লায় ভাস্কর্যের দিকে ভব’র টান বরাবরের। নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘে পাথরের প্রকাণ্ড ঠাকুর। উত্তরের চিলতে গলি সিকদারবাগানেও আয়নার সাজ, আলোর বিন্যাসের সঙ্গে ত্রিমাত্রিক পটভূমিতে আকাশে ভেসে থাকা প্রতিমার মায়াজগত্। পুজো যত এগিয়ে আসে, রান্নায় ফোড়নের
মতো থিমের মধ্যে ভব’র ভাবনা অদ্ভূত সব বাঁক নেয়।
সনাতন কিন্তু প্রতিমা, মণ্ডপ, আলো, আবহসঙ্গীত— সব কিছুতে একটা সমগ্রের আবেদন সৃষ্টিতে বিশ্বাসী। নলিন সরকার স্ট্রিট-হাতিবাগানের চিলতে গলির পুজোকে এক দশক ধরে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। এ বার বড়িশা ও যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লি দেবীর দু’টি রূপ তুলে ধরেছে। যোধপুর পার্কে দেবীর শাকম্ভরী মূর্তি। অসুরজয়ের পরে মর্ত্যে এসেছেন। কিন্তু বড়িশার প্রতিমা সনাতনের এ যাবত্কালের ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এতদিন দেবীর মাতৃমূর্তি, নারীমূর্তির মধ্যে সনাতন প্রেরণা খুঁজেছেন। কিন্তু বড়িশার প্রতিমা এক ধরনের অলৌকিক পটভূমিতে যেন পাশের বাড়ির মেয়ে। তার আভরণে অবশ্য ছক-ভাঙা কল্পনার মিশেল। সনাতন বলছিলেন, “চারপাশে মেয়েদের উপরে অত্যাচারের এত ঘটনা, তাই আমার প্রতিমাও কেমন পাল্টে গেল।” মণ্ডপে মাটির কাজে মহিষাসুরবধের পরের উত্সবের আবহ। মণ্ডপের বাইরে শিব-সতীর প্রেমমুগ্ধ মূর্তি মন ছুঁয়ে যায়।
থিমপুজোর প্রতিযোগিতার দৌড়েও এমন শিল্পী কিন্তু আছেন, যিনি স্রেফ ঠাকুর দেখবেন বলে এক বছর পুজোর কাজ থেকে বিশ্রাম নিয়ে থাকেন। নিজেকে আরও শাণিত করে এক বছর বাদে রণ বন্দ্যোপাধ্যায় ফিরে এসেছেন। তিনি আদতে বিজ্ঞাপনের পেশাদার। পুজোর ময়দানে নেমে অনায়াসে কলকাতার যে কোনও একটা কোণে ‘টাইম-স্পেস’-এর ঘেরাটোপ গুলিয়ে দিতে পারেন। বাদামতলায় তাঁর সৃষ্টি জংলাগড়ের থিম থেকে দেশ পত্রিকায় গল্প লেখা হয়েছিল। রণ-র পুজো মানেই একটা গল্পের আভাস। কিছু পুরনো স্থাপত্য ও গ্রামীণ জীবনের মোটিফ। আবার অকৃত্রিম আচারনিষ্ঠ পুজো। হিন্দুস্থান পার্কে আটপৌরে গ্রাম্য মন্দিরের মহালক্ষ্মীর দালানকে তুলে এনেছেন তিনি। চণ্ডীর সমষ্টি উপাসনার ধারা মেনে তিনটি মন্দিরে মহালক্ষ্মী, মহাকালী, মহাসরস্বতীর পুজো হচ্ছে। শাস্ত্রের নিয়ম মতেই তিন দেবীর সঙ্গে শিব-পার্বতী-গণেশ, ব্রহ্মা, সরস্বতী প্রমুখের পুজো হচ্ছে। মহিষাসুর, মধুকৈটভ, শুম্ভ-নিশুম্ভদের বিনাশ। মণ্ডপের উল্টো দিকে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর শিবের দালান। বেহালার নূতন দলেও রণ একটি গ্রামের দেবমন্দির ঘিরে সেবায়েতদের জীবনযাত্রা তুলে ধরেছেন। গ্রামের তক্ষকটির
ডাকও শোনা যাচ্ছে।
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ও থিমপুজোর পুরনো নায়ক। খড় থেকে এসি মেশিনের পাইপের ফোমের মোড়ক--- সব কিছুতে এ বার আছেন তিনি। অরূপ বিশ্বাসের সুরুচি সঙ্ঘের পুজোয় পশ্চিমবঙ্গের বৈচিত্র তিনি তুলে ধরছেন। সেখানেই মণ্ডপে রয়েছে খড়শিল্প। দার্জিলিংয়ের চা-বাগান, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ, শান্তিনিকেতনের খোড়ো ঘর--- সব উঠে আসছে এক সঙ্গে। দেশজ শিল্প, ইতিহাস, সংস্কৃতির ধরাধরি। শিবমন্দিরে সুব্রতর অন্য রূপ। এসি মেশিনের পাইপের ফোমকে তিনি রাজস্থানী বাঁধনির মতো সুদৃশ্য করে তুলেছেন। সেজে উঠছে প্রকৃতির সঙ্গে দেবীর মিলেমিশে যাওয়ার অজস্র মোটিফ।
থিমপুজোর অন্যতম পথিকৃত্ অমর সরকারকে বাদ দিয়েও কিন্তু কলকাতার পুজো নিয়ে আলোচনাই হতে পারে না। এ বার টালা বারোয়ারিতে বাংলার সাবেক নৌকো সাম্পানের টানে তিনি মজেছেন। নৌকোর দড়ি-দড়ার টানটুকু মিশে যাচ্ছে পুজোর আবেগের টানের সঙ্গে। কালীঘাটের ৬৬ পল্লির ‘আমার দুর্গা’র মধ্যে তীব্র বাস্তবের অভিঘাত। অমরের দুর্গার ভাবনায় মিশে যাচ্ছেন, দিল্লির ধর্ষিতা নারী থেকে মহাকাশাচারী কোনও নারী। থাকছেন বক্সার মেরিকম বা এভারেস্টজয়ী টুসি-ছন্দারাও।
অমরের সঙ্গে কাজ করেছেন, এমন শিল্পীরা অনেকে এখন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। একদা অমরের পুজোর প্রতিমাশিল্পী ছিলেন ভবতোষও। অমরের থিমের রূপকার আর এক মৃত্শিল্পী পূর্ণেন্দু দে-ও এখন থিম-শিল্পীদের মধ্যে প্রথম সারিতে। একদা অমরের সহযোগী, শিবশঙ্কর দাস, বিশ্বনাথ দে-কে নিয়েও তৈরি হচ্ছে প্রত্যাশা। রয়েছেন আরও অনেক শিল্পী। পুরনো ও নবীন শিল্পীদের সহাবস্থানে কলকাতার পুজোর একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হচ্ছে। |