মশলাগুঁড়োর মেশিনটা প্রথম দেখে থ হয়ে গিয়েছিলেন মীনা! কী অদ্ভূত! কারেন্টে চলে। মাইক্রোওভেনটাও আশ্চর্য বটে। দু’টোই বড় ছেলে বিধান এনেছিল বাড়িতে।
বিধানই চালাত যন্ত্রটা। খাবার গরম করা হতো। পুজোর রাতে বিরিয়ানির প্যাকেট আসত। বাড়িসুদ্ধ খাওয়াদাওয়া, হইহই। পাছে গ্যাসের ব্যথা হয়, মীনা নিজে ও-সব ছুঁতেন না। কিন্তু গোটা বাড়িটা আনন্দে ভরে গেছে দেখে বড় ভাল লাগত!
পুজোর দিনগুলো বুক ভরে একটা সুখের বাতাস নিয়ে শুতে যেতেন মীনা। এত দিনে ভাগ্যের চাকাটা ঘুরছে তা হলে। কোনও দিন পুজোয় নিজের জন্য একটা নতুন শাড়ি চাননি। স্বামীকে বলতেন, ছেলে দু’টোকে দাও। ওদের ভাল খাওয়াও, পরাও! তা হলেই হবে। স্বামী জগদীশ রায় সোদপুর কটন মিলের মজুর। কারখানায় যেতেন চটি ফটফটিয়ে। পাইপয়সা-গোনাগুন্তির সংসার। এই বুড়ো বয়সের পুজোয় সেই লোকটার হাব-ভাবেও নতুন ফুর্তি। তখন বিড়ি ফেলে ছেলের কাছে সিগারেট চাইবে! বড় বৌমার কাছে আবদার, ছেলেকে বল আমার নতুন জুতা চাই, আর বেল্ট! জামা গুঁজে পরতে হবে তো!
বৌমারা ঠাট্টা করতে ছাড়ত না। কেন, বাবা? এত সাজগোজ কীসের? কার সঙ্গে বেরোবেন? চুল কালো করতে করতে চোখ নাচিয়ে বৌমাকে শ্বশুরমশাইয়ের জবাব: ভাবছি, এ বার পুজোয় আমার বেয়ানের সঙ্গেই ঠাকুর দেখতে যাব! সকলে হেসে গড়িয়ে পড়ত। সে বড় সুখের দিন! হাসি চাপতে মীনাও আঁচলে মুখ ঢাকতেন।
সোদপুরের নাটাগড়ে তেতলা বাড়িটা জগদীশ স্বেচ্ছাবসরের থোক টাকাতেই তুলেছিলেন। কিন্তু সংসারটাকে বড় ছেলে বিধানই দাঁড় করায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাড়ি-বাড়ি ধূপকাঠি, ফিনাইল, বাদাম, চানাচুর বিক্রি করত। পুজোর সময়ে আলতা-সিঁদুরের কারবার। তার পর এক দিন অর্থ লগ্নি সংস্থা অ্যানেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের এজেন্ট হল। সোদপুরে অফিস যেত বুটজুতো পরে, গটগটিয়ে। সন্ধেয় গ্রাহকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কালেকশন। বাবাও সঞ্চয়ের তিন লাখ টাকা ছেলের হাতেই দেন। মাসে মাসে দেড় হাজারের বেশি সুদ। রোজকার ডালভাত জুটে যেত।
কিন্তু ছেলেটা যে জীবনে আরও কিছু চেয়েছিল। কোনও ফালতু খরচ নয়। একটু ভাল খেতে-পরতে চাওয়ায় কি দোষের কিছু আছে? তাই বর্ষার ইলিশ, কত রকমের মাছ আনত থলি ভরে। আনকোরা লাল ফ্রিজটায় ভরা হতো। লকার আলমারি, মিক্সি, মাইক্রোওভেন ঘরে ঢুকছিল একে-একে। সুখটা বেশি দিন সইল না।
বাড়িতে চড়াও হয়ে এক দিন সব তছনছ করে দিল ওরা। যা কিছু গয়নাগাঁটি, দামি আসবাব এর ওর ঘরে চালান করতে হয়েছিল ভয়ে। তার কিছু ফিরেছে। অনেক কিছুই ফেরেনি। কিন্তু জলজ্যান্ত মানুষগুলোই যে উবে যাবে, তা কি কখনও ভেবেছিলেন মীনা!
এখনও চোখ বুজলে দেখতে পান, বাড়ি বয়ে এসে বিধানের কলার চেপে ধরেছে পাওনাদারেরা। তখন সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে তুমুল হইচই। অ্যানেক্স কোম্পানি বন্ধ হওয়ায় ছেলেটা নিজেই কেস করতে ছুটেছিল খড়দহ থানায়। এক রাত লক-আপে থাকতে হল। পর দিন কোর্টে ছাড়া পেলেও আর ফিরতে পারেনি। কোর্টেই শেষ দেখা। প্রাণে বাঁচতে কোথায় গা-ঢাকা দিয়ে আছে কে জানে! একটি বার গলাও শুনতে পাননি আর! ভাবলে বুকের ব্যথাটা বাড়ে মীনার।
বুকের ব্যথাকেই তবু মনে-মনে ধন্যবাদ দেন তিনি। পাঁচ মাস আগের সেই রাত্তিরে ওই ব্যথাই যা সাথী হয়েছিল। বিধান ঘরছাড়া হওয়ার পরেও বাড়িতে পাওনাদারদের ভিড় কমেনি। দফায় দফায় চড়াও হয়ে গালিগালাজ, শাপশাপান্ত। বিধানের একরত্তি ছেলেটাকেও রেহাই দেয়নি। গ্রাহক-পাওনাদাররা বলছিল, বাচ্চাকে পরের টাকায় মানুষ করছিস, তার ফল পাবি! নাতির নাম করে যা নয় তাই অভিশাপ শুনে বুকের ব্যথাটা ফালা-ফালা করে দিয়েছিল মীনাকে। সে-রাতেই খড়দহে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। ভাগ্যিস! পরের দিনের বীভৎস দৃশ্যটা তাই আর দেখতে হয়নি।
শাশুড়ি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরের দিনই বড় বৌমা মিতাও ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে বাড়িছাড়া হয়! তার পরই ঘটেছিল ঘটনাটা। এখন যে মাঠে ঝলমল করছে আনন্দপুর ক্লাবের প্যান্ডেল, তার সামনেই জগদীশবাবু ও তাঁর ছোট ছেলে সুরেনকে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধেছিল ওরা। কোথায় লুকিয়েছিস বড়ছেলেকে, এখনই বল! চোরের গুষ্টি, ৩০ লাখ টাকার ব্যবস্থা না-করলে ছাড়া পাবি না। সন্তানের বয়সি হিংস্র মুখগুলোর লাথি-ঝাঁটা-জুতোয় ক্রমশ মাটির সঙ্গে মিশে যেতে থাকেন প্রৌঢ়। সন্ধেয় ছাড়া পেলেও জগদীশবাবু আর পরের দিন সূর্য ওঠার অপেক্ষা করেননি। কাকভোরে ঘুম ভেঙে বাবাকে খুঁজতে গিয়ে সুরেন দেখে, ছাদের সিঁড়িতে কড়িকাঠ থেকে ঝুলছেন বাবা।
ছোট ছেলে বলতে থাকেন, সে-রাতে বাবাকে আগলাতে ওঁর পাশেই শুয়েছিলাম আমি। বাবা খালি বলছিল, সব শেষ! মান-সম্মান কিচ্ছুটি আর থাকল না! ভোরের দিকে কেন যে চোখটা লেগে গেল আমার!
জগদীশবাবুকে অপমান ও আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে পাশের বাড়ির দুই মহিলাকেও ধরে পুলিশ। এক মাস বাদে জামিনে ছাড়া পান তাঁরা। তাঁদের মা-ও ক্যানসারের রোগী। বিধানকে ছেলের মতো ভালবাসতেন। দু’লক্ষ টাকা অ্যানেক্সে রেখেছিলেন। দু’টো বাড়ির মাঝের একটা দরজা দিন-রাত খোলা থাকত। এখন তাতে তালা ঝুলছে।
মাথার উপর বাপ-দাদা নেই। বাপের সঞ্চয়ের সব টাকাও অ্যানেক্সে শেষ! সুরেন এখন সোদপুরের ব্রিজের মুখ থেকে মধ্যমগ্রাম অটো চালান। দু’ধারে পুজোর ভিড়। স্টিয়ারিংয়ে ঘাড় গুঁজে সুরেন ভাবেন, যে ভাবে হোক কোলের মেয়েটাকে নতুন কিছু দিতে হবে। বাড়িতে অসুস্থ মা, স্ত্রী, মেয়ে। পাঁচ মাসের আগের দুঃস্বপ্ন থেকে বেরোতে পারেননি কেউই। এখনও জোরে হাঁকডাক শুনলেই মায়ের হাত-পা কাঁপে। মেয়ে ঠোঁট ফোলায়, ওরা তোমাকে মারবে না তো বাবা!
মাঝেমধ্যে খবর আসে, কোন আত্মীয়ের বাড়িতে একবারটি হাজির হয়েছিলেন বিধান। কবে না কি, একবার কোর্টেও দেখা গিয়েছিল। ব্যস, ওইটুকুই। বিধান ও তাঁর স্ত্রীর মোবাইল এখনও বন্ধ। খাঁ খাঁ দোতলায় বড় ছেলের শূন্য ঘরে মাঝেমধ্যে ঢোকেন মীনা। প্রাণটা সব থেকে বেশি কাঁদে কত দিন না-দেখা নাতিটার জন্য। আদরের ঘন্টু! দেওয়ালের হাসিখুশি শিশুর পোস্টারে লেখা ‘হ্যাপি বেবি’। ছোটা ভীমের রঙিন স্টিকার, ঘণ্টুর টেডি বিয়ার যেন গিলে খেতে আসে!
জানলা খুলতেই ঠাট্টার মতো আছড়ে পড়ে সোনা রোদ। |