সরকারি ভাবে দক্ষিণবঙ্গ থেকে বর্ষার বিদায় নেওয়ার কথা আজ, মঙ্গলবার। অন্তত মরসুমি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৮ অক্টোবরই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এবং অভিজ্ঞতা বলছে, বিদায়লগ্নে বর্ষা সাধারণত কিছুটা মিইয়ে থাকে।
কিন্তু এ বার সেই ঝিমোনো মেজাজ কই?
উল্টে যাওয়ার সময় যত এগিয়ে আসছে, ততই ফুঁসে উঠছে মৌসুমি বায়ু। সকাল হোক বা বিকেল, সন্ধে হোক বা রাত, আকাশে ঘন কালো মেঘ জড়ো করে জল ঝরাচ্ছে অঝোরে, তুমুল বজ্রপাতে কাঁপিয়ে তুলছে দিগ্বিদিক। আর গমনোন্মুখ বর্ষার লেজের ঝাপটাতেই বেসামাল দুর্গাপুজোর শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। পুজোর পাঁচ দিন কেমন যাবে, তা ভেবে কর্মকর্তাদের ঘুম ছুটেছে। বর্ষা তার বিদায়-নির্ঘণ্ট মেনে বোধনের আগে আকাশ সাফ করে দিয়ে যাবে এমন আশার বাণী শোনা গেলেও নবমী থেকে ফের দুর্যোগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, সাগরে আবার নিম্নচাপ দানা বাঁধার ইঙ্গিত পেয়েছেন আবহবিদেরা।
শহরে পুজো উদ্বোধনের পালা শুরু হয়ে গিয়েছে শনিবার। এ দিকে বৃষ্টিতে ক্ষান্তি নেই। রবিবার রাতভর বর্ষণের পরেও সোমবার দফায় দফায় প্রবল বৃষ্টিতে নগরবাসী নাজেহাল। শেষ দুপুরে ঘণ্টা দুয়ের বৃষ্টিতে মধ্য ও উত্তর কলকাতা ডুবুডুবু। তার জের না-কাটতেই বিকেল পাঁচটা থেকে আকাশ কালো করে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি দক্ষিণে। রাস্তায় গোড়ালি থেকে হাঁটুডোবা জল। মণ্ডপে জমা জল বার করতে কালঘাম উদ্যোক্তাদের কপালে।
বস্তুত দক্ষিণবঙ্গে এ বার বর্ষা ঢুকেছে একেবারে দিনক্ষণ মেনে। ৮ জুন। তার পরে চার মাস ধরে চুটিয়ে ব্যাটিং করেছে। কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে। তাতেও কেন বর্ষার আশ মিটল না?
ব্যাপারটা নিয়ে আবহবিদেরা যেমন বিভ্রান্ত, তেমন উৎসবের আঙিনায় কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উদ্বিগ্ন। শনিবার একটি পুজোর উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি মা দুর্গার কাছে বৃষ্টি বন্ধ করার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। আর সোমবার আর এক উদ্বোধনে গিয়ে আমজনতাকে মমতা বলেছেন আকাশের কপালে টিপ পরিয়ে দিতে, যাতে মেঘের কালো নজর না-লাগে। ‘মাঝে-মধ্যে অল্প বৃষ্টি হওয়াটা ভাল। তাতে পরিবেশটা ঠান্ডা ঠান্ডা থাকে। তবে আকাশ কালো হয়ে যেন আর বৃষ্টি না হয়।” প্রার্থনা মুখ্যমন্ত্রীর। |
হাওয়া-বার্তা |
• ক্যালেন্ডার মানলে আজ বর্ষার বিদায়।
• কাল থেকে আকাশ পরিষ্কার হতে পারে।
• কিন্তু বঙ্গোপসাগরে নতুন নিম্নচাপের আভাস।
• সেটি ওড়িশা-অন্ধ্রে গেলে নবমী থেকে বাংলার উপকূলে বৃষ্টি।
• অভিমুখ ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গ হলে ভাসতে পারে দক্ষিণবঙ্গ। |
|
পুজোবিলাসী জনতা, উদ্যোক্তা থেকে শুরু প্রশাসনের শীর্ষ কর্তা সবারই এক কামনা। কিন্তু বাস্তবে আগামী ক’দিনে আবহাওয়ার মতিগতি কেমন থাকতে পারে? আবহবিদদের অভিমত কী?
এ দিনের দুরন্ত বর্ষণের পরেও আলিপুর আবহাওয়া দফতরের কর্তাদের কণ্ঠে কিছুটা আশাবাদ। তাঁদের অনেকে মনে করছেন, উৎসব শুরুর সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোগ কেটে যাবে। ক্যালেন্ডার মেনে আর আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে বর্ষা বিদায় নেবে, ফিরে আসবে শরতের আমেজ। ঝকঝকে আকাশ মাথায় নিয়ে শ্যামবাজার থেকে নাকতলা চক্কর কাটতে পারবেন দর্শনার্থীরা। যদিও এই ‘বরাভয়ের’ মেয়াদ ষষ্ঠী থেকে অষ্টমী। নবমী থেকে ফের দুর্যোগের আশঙ্কা। আলিপুরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ এ দিন বলেন, “সপ্তমী থেকে আকাশ পরিষ্কার হবে। তবে নবমী থেকে আবার বৃষ্টি শুরু হতে পারে।”
আশা-বাণীর পাশাপাশি এ হেন অলক্ষুনে কথা কেন?
কারণ একটি নিম্নচাপের আগমন-বার্তা। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিজ্ঞান দফতরের এক কর্তা জানিয়েছেন, আন্দামান সাগরে বুধবার নাগাদ একটি নিম্নচাপ তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে। পরে সেটি শক্তি বাড়িয়ে ওড়িশা-অন্ধ্র উপকূলের দিকে ধেয়ে আসতে পারে। “ওটা ওড়িশা-অন্ধ্রের দিকে গেলে নবমীর রাতে বা দশমীতে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী জেলাগুলোয় বৃষ্টি হতে পারে।” বলছেন গোকুলবাবু। কিন্তু নিম্নচাপ অভিমুখ বদলে ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের দিকে এলে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে দুর্যোগের সমূহ সম্ভাবনা, জানিয়েছে আলিপুর।
ঘটনা হল, গত জুন মাস ইস্তক বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া সব ক’টি নিম্নচাপই পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশা উপকূলে এসে ধাক্কা মেরেছে। তাই নতুন আর একটির আভাস পেয়ে আবহবিদদের মন কুডাক ডাকছে। গত পনেরো বছরে অবশ্য কলকাতায় পুরো পুজো একেবারে শুকনো খটখটে কখনও যায়নি। তবু এ বারের বৃষ্টির চরিত্রটা অন্যান্য বারের চেয়ে পুরোপুরি আলাদা ঠেকছে আবহবিদদের চোখে। যার জন্য দক্ষিণবঙ্গের বায়ুপ্রবাহের ‘স্বতন্ত্র পরিস্থিতি’র ভূমিকা দেখছেন তাঁরা।
আলিপুরের এক বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যা, দক্ষিণবঙ্গের পরিমণ্ডলে যেমন লাগাতার জলীয় বাষ্প ঢুকছে, তেমনই রয়েছে শুকনো, ভারী হাওয়া। দুইয়ে মিলে তৈরি করছে উল্লম্ব মেঘ। আর তা ভেঙে পড়ছে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে। এ দিনের মুষলধার বৃষ্টিরও মূলে ওই উল্লম্ব মেঘ। উল্লম্ব মেঘপুঞ্জ ভেঙে ঘন ঘন বাজও পড়েছে শহরজুড়ে। শনিবার বিকেলে এমনই বজ্রপাতে কালীঘাটের একটি পুজো মণ্ডপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আজ না হোক, কাল পঞ্চমীতে যাবতীয় প্রতিকূলতাকে সঙ্গে নিয়ে বর্ষা বঙ্গভূমি ছাড়বে বলে আবহাওয়া দফতরের আশা। মা দুর্গার কাছে আমবাঙালিরও একটাই প্রার্থনা।
|