আইনের ফাঁস নির্বিচার, অন্ধ। অপরাধকে সে একমাত্রিক ভাবে চেনে। এটাই তার ধর্ম।
কিন্তু বাস্তব রাজনীতি? তার দায় অপরাধের মূলে যাওয়া। তার অন্ধ হওয়া চলে না। লিখছেন
উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় |
এ বার দেবীপক্ষের আগমন আমাদের সচকিত করেছে একের পর এক তথাকথিত অসুর বিনাশে। গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র আইনসভাতে দাগি সাংসদ-বিধায়কদের আর যাতে স্থান না হয়, সেই মর্মে গত ১০ জুলাই মহামান্য শীর্ষ আদালত যে রায় ঘোষণা করেছেন তার বাস্তব প্রয়োগ শুরু হয়ে গিয়েছে। একাধিক সাংসদ তাঁদের পদ হারাতে চলেছেন। বাকিরা সন্ত্রস্ত। সংবাদমাধ্যমে যাঁদের নাম প্রকাশিত হচ্ছে তাঁরা তো বটেই, নিশ্চিন্ত নেই অনেকেই। কার ঝুলি থেকে কোন বেড়াল বেরিয়ে আসে কে জানে! মনে হচ্ছে অবশেষে ভারতীয় গণতন্ত্র মুক্তি পেল বোধহয়। এ বার রাজনীতিকরা সচেতন হবেন।
হলেই ভাল। নয়তো, আর একটি জনস্বার্থ বিষয়ক রায়ে শীর্ষ আদালত বলেছেন, নাগরিকরা ‘উপরের কাউকেই পছন্দ নয়’ বোতামটা টিপে দিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন। অতএব সাধু সাবধান। এমন প্রার্থী বাছো, যে এই সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ভোট দেওয়ার আগে প্রার্থীদের নাড়ি-নক্ষত্র সব জেনে রাখতে হবে। এমন সুসময় সত্যিই আগে আসেনি। |
‘দস্যুরানি’ এবং সাংসদ (১৯৯৬-৯৮, ১৯৯৯-২০০১)। ফুলন দেবী। |
গণতন্ত্র শুধু ভোটদান ও জনপ্রতিনিধিত্বের অধিকার চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। কত শতাংশ ভোট পড়ল বা কোন দল কতটা ভোট পেল তার চর্চা নিশ্চয়ই জরুরি। কিন্তু কেন ভোটদাতারা এক জনকে পছন্দ করছেন বা করছেন না, তার চর্চা কম মূল্যবান নয়। একই ভাবে, যাঁরা নির্বাচিত হচ্ছেন তাঁদের জনপ্রতিনিধিত্বের যোগ্যতার মাপকাঠি ঠিক কী হবে, তা-ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র শুধুমাত্র সংখ্যার খেলা নয়, আরও গভীরতর মূল্যবান এক যাপনের অঙ্গ হয়ে উঠুক— এটুকু চাওয়া অন্যায় নয়। ঠিক এই জায়গাতেই শীর্ষ আদালতের দুটি রায় অত্যন্ত সমর্থনযোগ্য।
কিন্তু অন্য এক প্রশ্নও ওঠে। গণতন্ত্রের ঝাড়াই-বাছাই পর্বে নাগরিক পছন্দ-অপছন্দের দিকটা যেমন দেখা প্রয়োজন, তেমনই দলভিত্তিক গণতন্ত্রে দলের মতাদর্শ বা রাজনীতিগত পছন্দ-অপছন্দ সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রক্রিয়া দুটি পরস্পর নির্ভরশীল। গণতান্ত্রিক কাঠামোর পরিমার্জন আইনসভা বা শীর্ষ আদালতের নির্দেশ মোতাবেক হতেই পারে। দাগিদের বহিষ্কার করা হল। প্রার্থী তালিকা নিয়ে দলগুলি নতুন করে ভাবতে বসল। ভাল। কিন্তু কাঠামোয় প্রাণ প্রতিষ্ঠা কে করবেন? আদালত না আইনসভা না কি রাজনৈতিক দল বা নাগরিক সমাজ? না কি, সেই দায়িত্ব নেবে খাপ পঞ্চায়েত, ধর্মীয় গোষ্ঠী, গ্রামের মোড়ল বা ভারতীয় পিতৃতন্ত্রের স্থির কাঠামোগুলি? উন্নত রাজনীতি দিয়ে সমাজকে নেতৃত্ব দেওয়ার বদলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজই নেতৃত্ব দেবে না তো রাজনীতির? প্রশ্নটা রইল। যে ব্যক্তি সমাজ ও রাজনীতির শীর্ষে থেকেও অন্যায় করছেন বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাঁর জনপ্রতিনিধিত্বের কোনও অধিকার নেই। কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্যায় বা পিতৃতান্ত্রিক হিংসা যাকে প্রতিহিংসার রাস্তায় যেতে বাধ্য করছে, আমাদের রাজনীতিতে তিনিও কি সমান দাগি?
দেবীপক্ষের আগমনে কি না জানি না, আজ কেবলই মনে পড়ছে অতীতের এক সাংসদের কথা। তিনি ‘দস্যুরানি’। ফুলন দেবী। ১৯৯৬ সালে উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ার আগে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদব তাঁর সমস্ত অপরাধ মকুব করে দিয়েছিলেন। শীর্ষ আদালতের এই রায় সেই সময় থাকলে ফুলন কিছুতেই প্রার্থী হতে পারতেন না। প্রার্থী না হওয়াটা বড় কথা নয়। আমাদের চিন্তা ফুলনের অপরাধ নিয়ে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী বা জনপ্রতিনিধি হয়ে, বা হওয়ার জন্য, কোনও অপরাধ করেননি। যা করেছেন, কেবলই বাঁচার জন্য। আত্মসম্মানের খাতিরে। যে সম্মান ‘ইন্ডিয়া’-বাসী ‘ভারত’বাসীকে দেয় না, উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণকে দেয় না, সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যালঘুকে দেয় না। সম্মান না দেওয়া এক জিনিস আর প্রতি দিন, অনুক্ষণ অসম্মানিত হতে বাধ্য করা অন্য বস্তু। কাঠামোগত পরিমার্জন, আদালতের হাজার হাজার পাতার রায়ে এই অসম্মানের যন্ত্রণা ধরা পড়ে না। আলোকিত সভ্যতা নিমেষে অন্ধকারকে শুষে নিতে চায়। কিন্তু অন্ধকারেরও একটা জীবন আছে। তার স্বর আমাদের কাছে পৌঁছয় না বলেই আমরা নিরাপদ বিতর্ক বিলাসে অবগাহন করি। যন্ত্রণাকে বুকে চেপে এগোতে হয় না। ‘নিরক্ষর’, ‘দাগি’ ইত্যাদি বিশেষণ নিয়ে আইনসভায় ঢুকেও শেষ রক্ষা না হওয়ার ঝুঁকি আমাদের বহন করতে হয় না।
বুন্দেলখন্ডের মাল্লা জাতের সন্তান ফুলন। ছোট থেকেই ডানপিটে। বাবার এক টুকরো জমি বাঁচানোর জন্য লড়ে যাওয়া মেয়ে। এগারো বছরেই একত্রিশ বছরের পুট্টিলাল-এর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল তাঁর। পুট্টিলাল-এর বিকৃতকাম ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ফুলন বিতাড়িত হলেন শ্বশুরবাড়ি থেকে। ডাকাতরা তুলে নিয়ে গেল।
গ্রামের যে জাতপাতের লড়াই, তাকে অস্বীকার করা ফুলনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বস্তুত এই জাতপাতের লড়াই ফুলনকে আরও বেশি করে হিংসা-প্রতিহিংসার আবর্তে নিক্ষেপ করেছিল। গুজ্জর ও ঠাকুরদের সঙ্গে নিম্নবর্ণ, বিশেষত মাল্লাদের নিরন্তর সংঘাতই বাস্তবতা। এই সংঘাতের কোনও ব্যাকরণ নেই। আইন-আদালতও নেই। চলছে তো চলছেই। সর্বত্রই তার ব্যাপ্তি। গ্রামজীবন থেকে দস্যুদল— এক দ্বন্দ্ব আর এক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন মাত্র। পুট্টিলাল-এর অত্যাচার আর দস্যু দলপতি বাবু সিংহ গুজ্জর-এর নৃশংসতায় কোনও ফারাক নেই। ফুলনের গ্রামে বাঁচার লড়াই। দস্যুদলেও তাই। ফুলন ভালবেসে ফেলেন সহদস্যু বিক্রম মাল্লাকে। বিবাহিত বিক্রমকে এক গভীর, সর্বনেশে ভালবাসা। বিক্রম মারে বাবু সিংহকে। দস্যুদলে মাল্লারাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর সুখী ফুলন বিক্রমকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেন। স্বাধীন ফুলন চাপে রাখেন উচ্চবর্ণের গ্রামগুলিকে। ক’দিনের সুখ এলোমেলো হয়ে যায়। বেহমাই গ্রামের ঠাকুর দলপতি শ্রী রাম ও লালা রাম-এর সহ্য হয়নি বিক্রম ও ফুলন সহ নিম্নবর্ণের এই উচ্চাভিলাষ। খুন হয়ে গেলেন বিক্রম মাল্লা। ১৯৮০-র অগস্টে। এর পর তিন সপ্তাহ ধরে ঘরে আটকে রেখে ফুলনের ওপর নাগাড়ে গণধর্ষণ চলল। ক্ষত্রিয় ঠাকুর সম্প্রদায়ের রজোগুণ নিম্নবর্ণ মাল্লা সম্প্রদায়ের স্পর্ধাকে চূর্ণ করতে চেয়েছিল। তিন সপ্তাহ বাদে শ্রী রাম ও লালারাম গ্রাম ছাড়ায় অবর্ণনীয় অত্যাচার থেকে মুক্তি পান ফুলন।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১। বেহমাই হত্যাকাণ্ড। শোনা যায় ফুলনের নেতৃত্বে খাকি পোশাক পরা দস্যুদল বেহমাইতে ঢোকে। বাইশজন গণধর্ষণকারীর ওপর গুলি চালায়। কুড়িজন মারা যায়। নিহতদের মধ্যে যদিও শ্রী রাম ও লালা রাম ছিল না। ফুলনের গণধর্ষণ নয়, বেহমাই-তে উচ্চবর্ণের হত্যার আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। যে প্রশাসন বর্ণহিন্দুর অত্যাচারে নীরব ছিল, সে নড়েচড়ে বসে। যে কোনও মূল্যে ফুলনকে চাই। অবশেষে ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩ সালে ফুলনদেবী ও মান সিংহ-এর নাটকীয় আত্মসমর্পণ। ফুলনের বয়স তখন কুড়ি।
অপরাধী? দাগি? নিশ্চয়ই। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া গুরুতর অপরাধ। কিন্তু যে প্রশাসন অসংখ্য সামাজিক অপরাধকে নীরব প্রশ্রয় দেয় সে কি অপরাধের জন্মদাতা নয়?
প্রশ্নটা জরুরি। আমরা আজ যে গণতান্ত্রিক কাঠামো পরিবর্তনের কথা ভাবছি তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে অবরোধের প্রাচীর তুললেই হবে না, অন্তর্ভুক্তির সুযোগও রাখতে হবে। জাতপাত, সম্প্রদায়ভিত্তিক জনমতের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে বহুমাত্রিক জনমত। আমাদের রাজনীতির সে কাজের দায় আছে। আইনের ফাঁস নির্বিচার, অন্ধ। অপরাধকে সে একমাত্রিক ভাবে চেনে। রাজনীতির দায় অপরাধের মূলে যাওয়া। তার অন্ধ হওয়া চলে না।
ফুলনদেবী বাঁচার জন্য অপরাধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আইনে তার কোনও ক্ষমা নেই। রাজনীতিতে সেই ভরসাটুকু ছিল বলেই আজ তিনি আইকন। আজও ভাবতে শিহরন লাগে, “In Behmai the bullets were flying/ bodies were dropping one by one/ she left her enemies dead or dying/ walked off tall, her vengeance done.” (দেবী গুলামের গান, ফুলন দেবীর জীবনীকার মালা সেন অনূদিত।)
|
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |