প্রবন্ধ ৩...
বলে ফেলেছেন, এই যা
রাহুল গাঁধী খুব অল্প পরিশ্রমে বিপুল নিন্দা এবং বিপুলতর হাসির উদ্রেক করেছেন। জনসমক্ষে অশোভন আচরণ করলে নিন্দে হবেই। হাসির কথা শুনে লোকে হাসবেই। কিন্তু সে সব থামলে কথাটাকে এক বার ঠাহর করে দেখে নেওয়া ভাল। কংগ্রেসের সহ-সভাপতি কৈফিয়ত দিয়েছেন, ‘মা আমাকে বলেছেন আমার মুখের ভাষা ভুল ছিল। আমি তা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমার সেন্টিমেন্টটা ভুল ছিল না।’ সেন্টিমেন্টটা ঠিক কী? নিশ্চয়ই শুধু এই নয় যে, দণ্ডিত জনপ্রতিনিধিদের রক্ষাকবচ দেওয়ার জন্য প্রস্তাবিত অর্ডিনান্সটিতে তাঁর আপত্তি ছিল। সে তো তাঁর অভিমত। অভিমত আর সেন্টিমেন্ট তো এক বস্তু নয়। বুঝতে অসুবিধে নেই, এই অর্ডিনান্স যে অর্থহীন, ননসেন্স, তা যে অবিলম্বে বাতিল করা উচিত— এটাই ছিল তাঁর সেন্টিমেন্ট। তাঁর মনের ভাব।
এ মনোভাব আমাদের খুব চেনা। আমরা যে কোনও বিষয়ে এই ভাবেই ভাবি। ভাবি যে, আমার যাতে আপত্তি, তা বাতিল করা উচিত। অবিলম্বে। আর ভাষা? ‘ননসেন্স’ বা ‘ছিঁড়ে ফেলুন’ গোছের শব্দগুলো রাহুল গাঁধী ক্ষমতার ঝোঁকে ভুল পরিস্থিতিতে উচ্চারণ করে ফেলে বিপাকে পড়েছেন, কিন্তু আমরা তো যে কোনও প্রশ্নে আমাদের আপত্তি জানাতে, প্রতিবাদ জানাতে হামেশাই এ সব শব্দাস্ত্র নিক্ষেপ করে থাকি। ওগুলো আমাদের কথার লব্জ।
কথা ভাবনার বাহনমাত্র। আমাদের ভাবনার ধরনটাই এই যে, আমি যা ঠিক বলে ভাবি, সেটাই ঠিক, বাকি সব ভুল। অর্থাৎ, আমি সত্য, জগৎ মিথ্যা। আমাদের এ-দিকে যাঁরা তার্কিক হিসেবে বিখ্যাত, তাঁরা যে কোনও বিষয়ে নিজের মতটা খুব জোর গলায় বলেন এবং বলতে থাকেন। অন্য মত তাঁরা শোনেন না, শুনলেও সপাটে ‘ননসেন্স’ বলে ছিঁড়ে ফেলে দেন, অথবা— বড়জোর— যে কোনও ভাবে গোটাকয়েক প্রতিযুক্তি সংগ্রহ করে সেই অন্যমতকে খণ্ডনের চেষ্টা করেন। খণ্ডন করতেই হবে— অন্য পথ নেই। আমাদের কাছে তর্ক মানে আসলে বক্সিং। কিংবা কুস্তি। কিংবা, হ্যাঁ, টি-টোয়েন্টি।
অন্য রকম ভাবনার অভ্যেসও কিন্তু সম্ভব। নিজের মতটাকে অনেকগুলো সম্ভাব্য মতের অন্যতম হিসেবে দেখার অভ্যেস। সেই অভ্যেস রপ্ত হলে বিরুদ্ধ মতের প্রতি আমাদের আচরণও পালটে যাবে। যে মত মানি না, প্রথমে তা শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনব, মানি না বলেই তাকে দ্বিগুণ গুরুত্ব দেব, সেই বিপরীত মতটিকে— বিপরীত বলেই— সব দিক থেকে যাচাই করার চেষ্টা করব, তার পর যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে বিচার করে দেখাব, কেন সেই মত সমর্থন করা যাচ্ছে না, অন্তত আমি কেন তা মেনে নিতে পারছি না। দমন করার ভাবনা নয়, হারিয়ে দেওয়ার ভাবনা নয়, এ হল সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মোকাবিলার ভাবনা।
এ ভাবে ভাবতে পারলে, এ ভাবে বিরুদ্ধ মতের মোকাবিলা করতে পারলে একটা মস্ত সুবিধেও হয় কিন্তু। তখন আর কোনও মতকেই ‘ননসেন্স’ বলে দাপট দেখাতে হয় না, কোনও ভাবনাকেই ছিঁড়ে ফেলে দেওয়ার হুকুম জারি করতে হয় না। সভ্যতা, সৌজন্য, এগুলো নিজগুণেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাহুল গাঁধীকে তাঁর জননী এই ভাবনা শেখাতে পারবেন কি না, শেখাতে চাইবেন কি না, তাঁরাই জানেন। কিন্তু আমরা আমাদের মতো করে অনুশীলন করতেই পারি! উল্টো কথা শোনার অনুশীলন। বিপরীত মতকে ছুড়ে না ফেলার, ছিঁড়ে না ফেলার অনুশীলন।
এক কালে তো এ অভ্যেস আমাদের ছিল। আমরা তর্ক করতে বসে প্রথমে ‘পূর্বপক্ষ’র ধারণা ও অভিমতগুলি বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করতাম, তার পর তা খণ্ডন করে নিজের মতের পক্ষে যুক্তি দিতাম। চেষ্টা করলে আবার পারব না কেন? অভ্যাসে মিলায় বস্তু।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.