|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
সর্বজনীন আইন বনাম খণ্ডিত ভারত |
খণ্ড-পরিচয়ের রাজনীতিতে জারিত ভারতে লালুপ্রসাদের জেল হয়ে ওঠে যাদবকুলপতির কারাদণ্ড।
আর তিনি? ‘পিছিয়ে পড়া অংশের রক্ষাকর্তা’, অতএব ‘চক্রান্তের শিকার’। কী ভাবে এই
রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রের সর্বজনীন সত্তার সংলাপ তৈরি হয়, ভবিষ্যৎ তার ওপরেই নির্ভর করবে। লিখছেন
শিবাজীপ্রতিম বসু |
গল্পটা পুরনো। ব্রিটিশ ভারতে তখন আইন অমান্য আন্দোলনের ধুম লেগেছে। বিশেষ করে, ছাত্র ও তরুণদের অনেকেই লেখাপড়া ও কাজকর্ম ছেড়ে আইন অমান্য করে জেলে যাচ্ছে। এমন আবহাওয়ায় এক কাকভোরে পুলিশ দর্জিপাড়ার দাগি চোর পঞ্চাকে তার বাড়িতে বমালসমেত গ্রেফতার করে। পাড়ার গলি দিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে পঞ্চাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চারিদিকে কৌতূহলী চোখ। হঠাৎ পঞ্চা হাত তুলে ধ্বনি দিতে থাকে: ‘বন্দেমাতরম্’। এর পর পঞ্চার ভাই-বন্ধু-চেলা-শাগরেদ চারিদিকে বলে বেড়াতে লাগল: দেখলেন তো, স্বদেশি বলে পুলিশ পঞ্চাকে চোর সাজিয়ে নিয়ে গেল! কিছু দিন শুনতে শুনতে নির্বিরোধী মধ্যবিত্ত ভাবল, ‘হবেও বা...’
ব্রিটিশ পুলিশের ভাগ্য ভাল, তারা ‘আইনের শাসন’ নামক এক গোদা (সর্বজনীন) আইনি ন্যায়বিচারের ধারণার আড়ালে কাজ করেছে, যার মোদ্দা কথা, আইনের চোখে সবাই সমান। ফলে, চোরকে ‘চোর’, ডাকাতকে ‘ডাকাত’, বাটপাড়কে ‘বাটপাড়’ ভাবতে তাদের ঢোক গিলতে হত না। ভাবতে হত না: চোরটি কোন সম্প্রদায় বা জাতপাত রাজনৈতিক দলের সদস্য। কলোনীয় পুলিশের উত্তরসূরি, আজকের উত্তর-ঔপনিবেশিক ইন্ডিয়া বা ভারতের পুলিশওয়ালাদের কিন্তু এমন সৌভাগ্য বড় একটা নেই। বহু সময়েই, চোরটি তার কাছে কোনও না কোনও নির্দিষ্ট দল (যেমন, পশ্চিমবঙ্গে), সম্প্রদায় বা জাতপাত (উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতে), বা কৌম-গোষ্ঠীর সদস্য!
অনেক সময়েই সম্প্রদায়, জাতপাত, কৌম-গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের গাঁটছড়া বাঁধা থাকে, তাতে অনুপানটি আরও তীব্র হয়। তখন, সাদা কথায়, সরকারি তবহিলের তছরুপকারীও হয়ে ওঠে কখনও ‘দলিতোঁ কা বেটি’, কখনও বা ‘পিছড়ে বর্গ’-এর মসিহা। তখন পুলিশ-প্রশাসন সদা-তটস্থ: অভিযুক্ত ব্যক্তির চারিদিকে রয়েছে রাজনৈতিক সামাজিক ‘পরিচয়’-এর বলয়, লাখ লাখ সমর্থক রয়েছে, রয়েছে সংবাদমাধ্যমের সদাজাগ্রত শ্যেনদৃষ্টি। পান থেকে চুন খসলেই, কখন কী ঘটে যায়, কিস্যু বলা যায় না...! |
|
বহু কোটি টাকার পশুখাদ্য কেলেংকারি মামলায় প্রথম বার জামিন পাওয়ার পর, লালুপ্রসাদ এর পিছনে ‘উচে জাত কি লোগোঁ’ তথা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ‘সাজিশ’ দেখতে পান, এবং সগর্বে ও সকৌতুকে বলেন, ‘ম্যায় নেহি মাখন খায়ো’! রাঁচির আদালতে পাঁচ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে এবং লোকসভার আসন ও আগামী ১১ বছর নির্বাচনে লড়ার অধিকার খুইয়ে অবশ্য তিনি বেবাক চুপ মেরে গেছেন। জেলের সেলে গাঁধীজির ছবি টাঙিয়েছেন। যদিও তাঁর পুত্র-পরিবার ও দলবল বাজিয়ে চলেছেন উঁচু জাতের কারসাজির বিরুদ্ধে অভিযোগের ফাটা রেকর্ড। বলছেন, এক দিকে আইনি লড়াই, অন্য দিকে রাজনৈতিক সংগ্রাম, দুইয়ের মিশ্রণে লালুজির হৃত সম্মান (এবং ক্ষমতা) পুনরুদ্ধার করবেন! উত্তর ভারতের আর এক মহাদাপুটে নেত্রী মায়াবতীও যখনই আয়ের সঙ্গে সংগতিহীন সম্পত্তির ব্যাপারে আইনি প্যাঁচে পড়েন, তখনই তিনি ‘মনুবাদী’ (ব্রাহ্মণ্যবাদী) ব্যবস্থা বা চিরবিরোধী মুলায়ম সিংহের সাঁট স্পষ্ট দেখতে পান এবং বলেন, দলিতের বেটি বলেই তাঁর ঐশ্বর্য, পোশাকআশাক নিয়ে এত চর্চা, আসলে উঁচু জাতের লোকেরা দলিতকন্যার বাড়বাড়ন্ত চোখে দেখতে পারে না, তাঁকে হিংসে করে।
সত্যিই তো, অপরাধী কি কেবল নিম্নবর্গেই আছে, উচ্চবর্ণের মানুষ কি ধোয়া তুলসী পাতা? তা ছাড়া, যুগ যুগ ধরে শাসন ক্ষমতা ভোগ করে, বা শাসকের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষির সুযোগে তারা কি ধনসম্পদ সুযোগসুবিধা মানসম্মান পেয়ে নিম্নবর্গ বা দলিতদের চেয়ে সামাজিক রাজনৈতিক বৌদ্ধিক দিক থেকে বহু যোজন এগিয়ে যায়নি? এত দিন না-পাওয়ার দলে যারা, তারা এখন কিছুটা বেশি সুবিধা পেলে, বা, তাদের দু-এক জন নেতা-নেত্রীর আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে উচ্চবর্গের বাবুবিবিদের এত গোঁসা কেন? ইঙ্গশিক্ষিত এলিটকুল সেমিনারে জন রলস-এর ন্যায্য-বিতরণের তত্ত্ব আওড়াবে, সুযোগসুবিধা বা স্বাধীনতায় অসম লোকেদের মধ্যে ওই সব উপাদানের বিমূর্ত সমবিতরণ নতুন করে অসাম্য জিইয়ে রাখবে, সে সব নিয়ে গুরুগম্ভীর পেপার লিখবে, আর বাস্তবে যদি কারও নিম্নবর্গ পরিচয়ের সুবাদে কিঞ্চিদধিক প্রাপ্তি ঘটে, তবে ‘মেধাতন্ত্র’-এর বান ছোটাবে! যুগসঞ্চিত লোভ আর খিদের তাড়নায় যদি নিম্নবর্গের কেউ একটু আধটু দুর্নীতি করে, তবে তাকেই বড় করে দেখাবে!
এই ভাবে বুঝলে, ভারত তথা তৃতীয় বিশ্বের সামাজিক ‘ভিন্নতা’কেন্দ্রিক পরিচয়ের ভিত্তি সম্পর্কে ধ্যানধারণা খানিক স্পষ্ট হবে। কিন্তু গোল বেধেছে সে দিন, যখন এই ভিন্নতাধর্মী সামাজিক বাস্তবতার ওপরে চেপেছে উদারনৈতিক রাষ্ট্রের সর্বজনীন বিমূর্ত আইনি পরিচয়ের চাদর। এই আইনের দেবীর চোখ বাঁধা, ফলে তিনি মানুষের মুখ বা মূর্তি দেখতে পান না। ফলে, ব্যক্তিগত বা কৌম পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়, তিনি ন্যায়বিচার করেন সর্বজনীন (‘সবার জন্য একই নিয়ম’, এই অর্থে) কিছু নীতির প্রেক্ষিতে। ভারতে এই সর্বজনীন আইনের শাসনের জন্ম ব্রিটিশ আমলে।
এখন, এই ধরনের ‘সর্বজনীন’ আইনের শাসন তখনই সফল হতে পারে, যখন তার প্রয়োগ ঘটে ‘সর্বজনীন’ সদস্যদের ওপর যারা নির্দিষ্ট পরিচয়ের দ্বারা আবদ্ধ নয়, অর্থাৎ কোনও নির্দিষ্ট বা ভিন্নতাধর্মী সামাজিক বা কৌম পরিচয়ের বাহক নয়, যারা রাষ্ট্রের বিমূর্ত সদস্য, মানে ‘নাগরিক’। ১৮৫৮ সালে ‘মহারানির ঘোষণা’য় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ার পরে অবশ্য ভারতে আনুষ্ঠানিক অর্থে কোনও ‘নাগরিক’ ছিল না, ছিল ‘প্রজা’ বা ‘সাবজেক্ট’। কিন্তু এই পরিচয়টিও আসলে সমসত্ত্ব সর্বজনীনতার ওপরে প্রতিষ্ঠিত। ফলে, নানা অত্যাচার বা অবিচার থাকলেও গোড়ায় ব্রিটিশ শাসনে আইনের শাসনযন্ত্রটি মোটের ওপর গড়গড় করেই চলত। নিন্দেমন্দ হয়েছিল, যখন ১৯০৯ সালের মর্লি-মন্টো শাসন সংস্কারে আইন পরিষদের স্বদেশীয় নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে মুসলিমদের জন্য ‘পৃথক’ আসন সংরক্ষিত হল। পরে এই ‘সংরক্ষণের রাজনীতি’র ভরবেগ আরও বেড়ে নানা চড়াই-উতরাই, গলি-রাজপথ পেরিয়ে দেশ দ্বিখণ্ডিত ও স্বাধীন হয়।
স্বাধীন ভারতে ব্রিটিশ প্রজারা এবং ভারতভুক্ত দেশীয় রাজ্যের প্রজারা সবাই রাতারাতি ‘নাগরিক’ হয়ে ওঠে। ‘নাগরিক’ মানে কিছু সাধারণ বা সর্বজনীন অধিকার ও কর্তব্যে বাঁধা রাষ্ট্রের সদস্য। পশ্চিমি ভুবনে কয়েক শতাব্দীর (অনেক সময়, রক্তক্ষয়ী) সংগ্রামে মানুষ এই নাগরিক অধিকার অর্জন করে। ভারতে তেমন ঐতিহ্য না থাকায় এবং সামাজিক ভিন্নতা অনেক বেশি হওয়ায় সাধারণ নাগরিকত্বের এই ধারণা এ দেশে কতটা বাস্তবোচিত, সে প্রশ্ন গোড়া থেকেই ছিল। তবুও নতুন সংবিধানের দৌলতে এ ধারণা চালু হয়। যদিও এর পাশাপাশি সাংবিধানিক ভাবেই পুরনো সংরক্ষণের ধারাটি টিকিয়ে রাখা হয়— মুসলিমদের জন্য ব্রিটিশ আমলের সংরক্ষণ বিলুপ্ত হয়, আসে তফসিলি জাতি ও জনজাতির জন্য সংরক্ষণ। সংরক্ষণের এই ধারণা পরে আরও বিস্তৃত হয়ে আইনি ও রাজনৈতিক ভাবে এমন এক মাত্রায় পৌঁছেছে যে, দেশের জনগণের এক বিপুল অংশ কোনও না কোনও ধরনের সংরক্ষণের আওতাধীন।
ফলে ভারতে এখন দু’ধরনের নাগরিক: এক দল ‘সাধারণ’ (কোনও বিশেষ পরিচয়ের নয়), অন্যরা নানা সামাজিক বা কৌম পরিচয়-সম্পন্ন। সমাজবিজ্ঞানীরা অবশ্য শেষোক্ত গোষ্ঠীকে ‘নাগরিক’ নয়, মুখ্যত, সামাজিক বা কৌম পরিচয়-ভিত্তিক জনসমাজের অংশ বলেই মনে করেন। উত্তর-আধুনিক বা উত্তর-ঔপনিবেশিক পাঠের চর্চাও ‘সমগ্র’ বা ‘সাধারণ’-এর বিপ্রতীপে খণ্ড বা নির্দিষ্টের ওপর জোর দেওয়ায় এই পরিচয়-ভিত্তিক রাজনীতি তাত্ত্বিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে সবল হয়। এই দিক থেকে, ‘নাগরিক’ শব্দটি সংকুচিত হয়ে, হয়ে ওঠে অল্প কিছু মানুষের সাধারণ পরিচয়। এই ‘সাধারণ’ নাগরিকরা চুরি-বাটপাড়ি বা অন্য ‘অপরাধ’ করলে, সাধারণ ভাবে ‘অপরাধী’র তকমা পায়। বাকিরা অপরাধ করলে বর্ণিত হয় অমুক জাতপাত বা তমুক কৌমগোষ্ঠীর সদস্য এবং ‘অপরাধী’ হিসেবে। অনেকের মনে (এবং গণমাধ্যমের বর্ণনায়) এমন সমীকরণও মাঝে মাঝে প্রশ্রয় পায় যে, ও অমুক জাতপাতের সদস্য, তাই ‘অপরাধী’। লালুপ্রসাদের জেল তাই হয়ে ওঠে যাদবকুলপতির কারাদণ্ড, আর তাঁর অন্ধভক্তদের কাছে— যেহেতু তিনি ‘যাদব’, ‘পিছিয়ে পড়া অংশের রক্ষাকর্তা’, তাই ‘চক্রান্তের শিকার’। এই উত্তর-আধুনিক খণ্ড-পরিচয়ের কালে, ভারতের মতো উদারনৈতিক উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কী ভাবে খণ্ডের বাস্তবতার সঙ্গে সাধারণ বা সর্বজনীন তথা বিমূর্ত সত্তার চলমান সংলাপ নির্মাণ করতে পারে, তার ওপরেই নির্ভর করবে তার ভবিষ্যতের সার্থকতা।
|
শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |
|
|
|
|
|