কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সহ কয়েক জন কর্মকর্তা সম্প্রতি ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পড়িয়াছিলেন। বিক্ষোভ ঘেরাওয়ের রূপ ধারণ করিয়াছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে বি টেক পড়ুয়াদের একাংশের দাবি, পাঠ সাঙ্গ করিবার পরে তাঁহাদের কর্মসংস্থানের সুবিধা হইতেছে না, বিশ্ববিদ্যালয় এই বিষয়ে তাঁহাদের জন্য যথেষ্ট তৎপর হইতেছে না, তাঁহাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হইতেছে। ঘেরাও একটি গর্হিত কর্ম, তাহা লইয়া নূতন করিয়া বলিবার কিছু নাই। কিন্তু ঘটনার স্তরে সীমিত না থাকিয়া যদি তাহার পরিপ্রেক্ষিতটি বিচার করা যায়, ঘটনার পশ্চাদ্বর্তী ধারণা বা নীতি বিচার করা যায়, তবে দেখা যাইবে, যে দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের এই বিক্ষোভ, তাহাও যুক্তিগ্রাহ্য নহে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় তাহার ছাত্রছাত্রীদের চাকুরি জোগাড় করিয়া দিতে বাধ্য থাকিবে কেন? তাহা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ? বিভিন্ন বিষয়ে অনেক প্রশিক্ষণ সংস্থা সুনিশ্চিত চাকুরির প্রতিশ্রুতি দিয়া থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় তো তেমন প্রতিশ্রুতি দেয় না, দিতে পারেও না। দৃশ্যত, ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কোর্সের সহিত এই কোর্সটির তুলনা করিতেছেন এবং তাহাদের অনুরূপ ‘প্লেসমেন্ট’-এর নিশ্চয়তা চাহিতেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকরা যদি এই বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করিতে চাহেন, করিবেন। কিন্তু তাহার কোনও বাধ্যবাধকতা থাকিতে পারে না।
এই সূত্রেই আর একটি প্রশ্ন ওঠে। গভীরতর প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোর্স কেন, যাহার মূল্য কেবলমাত্র ‘প্লেসমেন্ট’ দিয়া নির্ধারিত হইবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তো জ্ঞানান্বেষণ, উচ্চ স্তরের বিদ্যার চর্চা। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে ছাত্রছাত্রীদের নিশ্চয়ই কাজ খুঁজিতে হইবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সেই কাজের পক্ষে জরুরিও বটে। কিন্তু তাহা বিদ্যার ব্যবহারিক প্রয়োগ, সেই প্রয়োগের সামর্থ্য বিদ্যাচর্চার লক্ষ্য হইতে পারে না। বস্তুত, সংশ্লিষ্ট বি টেক কোর্সটিই এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। এই পাঠ্যক্রম যখন উদ্ভাবিত হয়, তখন প্রযুক্তি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার উদ্দেশ্যেই তাহা রচিত হইয়াছিল। ব্যবহারিক প্রযুক্তি শিক্ষার প্রচলিত পাঠ্যক্রমগুলি হইতে এই কোর্স মূল চরিত্রে স্বতন্ত্র। কিন্তু কালক্রমে ইহাও অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর নিকট একটি বৃত্তিশিক্ষায় পরিণত হইয়াছে। চাকুরির দাবি তাহারই পরিণাম। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবিয়া দেখা কর্তব্য, এমন একটি পাঠ্যক্রম আদৌ রাখিবার কোনও প্রয়োজন আছে কি না। যদি রাখিতেই হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত না করিয়া স্বতন্ত্র একটি শাখার হাতে তাহা তুলিয়া দেওয়াই বিধেয়।
বস্তুত, এই উপলক্ষে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সামগ্রিক পর্যালোচনা করিতে পারে, যে সমস্ত পাঠ্যক্রম এখন সেখানে পড়ানো হয়, তাহাদের কতগুলি বাস্তবিকই জ্ঞানান্বেষণ, আর কতগুলি নিতান্ত বৃত্তিশিক্ষা। পশ্চিম দুনিয়ায়, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চমানের বিশ্বদ্যিালয় বা অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের বৃত্তিসর্বস্ব প্রশিক্ষণের জন্য স্বতন্ত্র সহযোগী প্রতিষ্ঠান তৈয়ারি হইয়াছে, মূল বিশ্ববিদ্যালয় হইতে তাহাদের স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত। বৃত্তিশিক্ষাকে হেয় করিবার কিছুমাত্র কারণ নাই, তাহাও অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু তাহা জ্ঞানের অন্বেষণ নহে। একটি অবাঞ্ছিত ঘটনা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চশিক্ষার অর্থ ও আপন কর্তব্য বিষয়ে গভীর চিন্তার সুযোগ করিয়া দিয়াছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাইলে লাভ বই লোকসান নাই। |