অন্ধ্রপ্রদেশের আগুন নির্বাপিত হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। উপরন্তু যত দিন যাইতেছে, ততই রাজ্য-ভাগের বিরুদ্ধে জনমত বিস্ফোরিত হইতেছে। এত কাল সাবেক অন্ধ্রপ্রদেশকে বিভক্ত করিয়া স্বতন্ত্র একটি তেলঙ্গানা রাজ্য গঠনের দাবিতে অশান্তির আগুন জ্বলিতেছিল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা বিভাজনের সিদ্ধান্তের উপর সিলমোহর লাগাইয়া দেওয়ায় বিভাজনপন্থীরা কিছুটা নিরস্ত হইলেও বিভাজন-বিরোধীরা কোমর বাঁধিয়া ময়দানে অবতীর্ণ। রাজ্যকে অবিভক্ত রাখার আন্দোলন প্রধানত হইতেছে তেলঙ্গানা-বহির্ভূত রায়লসীমা ও সীমান্ধ্র অঞ্চলের (অর্থাৎ সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের) জেলাগুলিতে। এই আন্দোলন আবার গতি পাইয়াছে জগন্মোহন রেড্ডির জামিনে মুক্তির পর। অন্ধ্রপ্রদেশে তিনি এবং দিল্লিতে তেলুগু দেশম নেতা চন্দ্রবাবু নায়ডু অনশনে বসিয়াছেন। উভয়েরই দাবি রাজ্যকে ভাগ হইতে না দেওয়া।
তেলঙ্গানার দাবিতে আন্দোলনের মোকাবিলায় সরকার যে পদ্ধতি অবলম্বন করিয়াছিল, তেলঙ্গানা-বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলাতেও সেই একই পন্থা অনুসৃত হইতেছে। পুলিশ, আধা-সামরিক বাহিনী নামাইয়া, ১৪৪ ধারা ও কার্ফু জারি করিয়া, লাঠি-চার্জ ও শূন্যে গুলি ছুড়িয়া মত্ত জনতাকে ছত্রভঙ্গ ও সংযত করার চেষ্টা হইতেছে। বড় রকমের কোনও অপকাণ্ড এখনও ঘটে নাই। তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিণ্ডে অবস্থা দেখিয়া ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন, ভবিষ্যতে আর কোনও রাজ্যকে ভাঙিয়া পৃথক রাজ্য গড়া হইবে না। এ ধরনের অঙ্গীকার মুখে উচ্চারণ করা যত সহজ, কাজে পরিণত করা তত নয়। কেননা এক বার তেলঙ্গানার ব্যাপারে সম্মত হওয়ার পর সরকারের পক্ষে অন্যান্য রাজ্যের দাবিদারদের যুক্তি খণ্ডন করা সম্ভব নয়। যুক্তি যখন কাজ করে না, তখন জবরদস্তি, চাপ দিয়া দাবি আদায়ের রাজনীতি মুখ্য হইয়া ওঠে। তেলঙ্গানা রাজ্য গঠনের দীর্ঘ দিনের দাবিও কার্যত আন্দোলনকারীরা চাপ দিয়াই আদায় করিয়াছেন। সেই চাপের কাছে নতিস্বীকারের পিছনে শাসক দলের তরফে নির্বাচনী রাজনীতির হিসাবনিকাশ থাকিতেই পারে। তবে এক বার নতিস্বীকারে অভ্যস্ত হইয়া গেলে শাসকদের উপর্যুপরি ‘ব্ল্যাকমেল’-এর শিকার হইতেই হইবে। আজ অন্ধ্রের প্রজ্বলিত আগুন নিভাইতে ব্যর্থ হইয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যে কথা বলিতেছেন, তাহা দমকল মন্ত্রকের কথা বলিয়া ভ্রম হয়। আগুন নেভানো নয়, তাহা জ্বলিয়া উঠিতেই না দেওয়াই হইল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাজ।
বস্তুত, তেলঙ্গানার দাবি যে ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য দার্জিলিং এবং উত্তর-পূর্বের বড়ো-কার্বি-ডিমাসা জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় পৃথক রাজ্যের অবাস্তব দাবিকে আস্কারা দিয়াছে এবং নূতন করিয়া অশান্তি, হিংসা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসের আগুন জ্বলিয়া ওঠার উপক্রম করিতেছে, তাহার পিছনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তথা ইউপিএ সরকারের পরোক্ষ দায় আছেই। বহু কাল পর পার্বত্য দার্জিলিঙে শান্তি ফিরিয়া আসার পর তেলঙ্গানাই যে গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে উস্কাইয়া তুলিয়াছে, ইহা অস্বীকার করিবে কে? তাই ভবিষ্যতে আর কোনও রাজ্য ভাঙিয়া নূতন রাজ্য গড়া হইবে না, এমন আশ্বাস বা হুমকি কতখানি বিশ্বাসযোগ্য? আত্মপরিচয়ের রাজনীতি করা কিংবা জনজাতীয় আত্মশাসনের দাবিতে মুখর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতেও পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন করিবে। সেই সব আন্দোলন সফল হইবে কি না, তাহা নির্ভর করিবে আন্দোলনকারীদের দাবির যৌক্তিকতার উপর নয় (একটি জেলার তিনটি মহকুমা লইয়া গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার দাবির তো কোনও যুক্তিই থাকিতে পারে না), শাসক গোষ্ঠীকে চাপ দিয়া নত করিতে পারার ক্ষমতার উপর। ইহা বিপজ্জনক। সংহতিচেতনার পক্ষে যেমন, তেমনই যুক্তরাষ্ট্রীয়তার পক্ষেও। |