নীতিগত প্রশ্ন উঠেছিল আগেই। সারদা-কাণ্ডে প্রতারিত আমানতকারীদের সরকারি কোষাগার থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্তের আইনি বৈধতা নিয়েও এ বার প্রশ্ন তুললেন রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত।
প্রতারকদের কুকর্মের দায় কেন জনগণের করের টাকা থেকে সরকার মেটাবে, ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সময় থেকেই সেই প্রশ্ন
তুলে আসছে প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী-সহ রাজ্য সরকারের তরফে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, আইন মেনে এবং আদালতের সম্মতি অনুসারেই ওই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। তারই জবাবে এ বার নথিপত্র হাতে মুখ খুলেছেন অসীমবাবু।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, “আমরা তো বলছি, বিভিন্ন আর্থিক সংস্থার হাতে ক্ষতিগ্রস্ত সব মানুষকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। কিন্তু সেটা দিতে হবে প্রতারকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এবং তার পর তা নিলামে বিক্রি করে। সরকার কোন আইন মেনে কোষাগারের টাকায় ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে?”
অসীমবাবুর যুক্তি—
প্রথমত, সারদার মতো আর্থিক সংস্থাগুলির অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিষয়গুলি দেখে সেবি। গত ২৩ এপ্রিল সেবি নির্দেশ দিয়েছিল, নিজেদের সম্পত্তি থেকেই সারদাকে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে হবে। তা হলে রাজ্য সরকার এখন নিজেরা টাকা দিচ্ছে কেন?
দ্বিতীয়ত, গত এপ্রিলেই বিধানসভায় পেশ করা রাজ্য সরকারের বিলে বলা হয়েছিল, সেবি-র রূপরেখার আওতায় থাকা কোনও আমানত ফেরতের দায় সরকার বা তার জন্য নিযুক্ত সংশ্লিষ্ট কমিশনের হবে না। সরকারের নিজের যুক্তিতেই তা হলে সারদার আমানতকারীদের জন্য সরকারি অর্থ খরচ করা উচিত নয়। উপরন্তু সেই বিল আবার প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। |
সিউড়ি থানায় সুদীপ্ত সেন। রবিবার। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |
এখন তা হলে এই বিষয়ে আইন কোথায়?
তৃতীয়ত, রাজ্য সরকার বলেছে, ক্ষতিপূরণ আপাতত তারা মিটিয়ে দিচ্ছে। পরে শ্যামল সেন কমিশন সারদার সম্পত্তি থেকেই টাকা তুলে সরকারকে তা ফেরত দিয়ে দেবে। কিন্তু গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজ্য সরকারের জারি হওয়া বিজ্ঞপ্তিতে
(নং: ৫০১-জিই (স্যাংশন)/ পিএল/ও/৪৪সি-৪৫/১৩(পিএল-১) কোথাও বলা নেই যে, সরকার আপাতত ক্ষতিপূরণের টাকা অগ্রিম হিসাবে দিচ্ছে। পরে কমিশন ঋণের মতোই তা ফেরত দেবে! প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে রবিবার রাজ্য সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু বলা হয়নি। তবে এক মন্ত্রীর বক্তব্য, “জনস্বার্থে সরকারকে অনেক কিছুই করতে হয়। গরিব মানুষ যাতে তাড়াতাড়ি কিছু টাকা ফেরত পান, তার জন্যই সরকার কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। পরে সারদার সম্পত্তি থেকেই টাকা তোলা হবে। তার প্রক্রিয়া চলছে।”
তথ্যের পাশাপাশি অসীমবাবু অবশ্য সাংবিধানিক সংস্থানের কথা উল্লেখ করে দাবি করেছেন, “করের টাকায় প্রতারকদের কাজের ক্ষতিপূরণ দেওয়া কোন জনস্বার্থের মধ্যে
পড়ে?” ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়া যে ভাবে চলছে, তা নিয়ে বামেরা যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দরবার করবে, সে ইঙ্গিতও ফের দিয়েছেন অসীমবাবু। রাজ্যের আর্থিক শৃঙ্খলা নিয়ে
সিএজি-র রিপোর্ট নিয়ম মোতাবেক বিধানসভায় পেশ করা হয়েছে, তুলেছেন সেই প্রশ্নও।
এরই সঙ্গে সর্বশেষ রাজ্য বাজেটের তথ্য দেখিয়ে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রাজ্যের মোট আয় প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা। ঋণের সুদ বাবদ খরচ হয় ২৮ হাজার কোটি। সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকদের বেতন ও পেনশনের জন্য ৪২ হাজার কোটি। তার পরেও হাতে থাকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সেই টাকা কী ভাবে খরচ করা হবে, তার অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে রাজ্য সরকারকেই। অসীমবাবুর মন্তব্য, “অনেক সমস্যার মধ্যেও আমরা কিন্তু বছরে দু’বার মহার্ঘ ভাতা দিতাম!” টাকার অভাবে যা এখন স্থগিত রেখেছে বর্তমান
রাজ্য সরকার।
বিপুল খরচের প্রশ্নেই ‘নবান্ন’ সাজানো নিয়েও কটাক্ষ করছে সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু যেমন এ দিনই দিল্লিতে বলেছেন, “নবান্ন ভবন আগেই রং করা ছিল। আবার রং করা হয়েছে! এমন আরও খরচ করা হয়েছে। এক দিকে সরকার বলছে টাকা নেই। অন্য দিকে কোনও খোঁজখবর না-করেই ক্লাবগুলিকে
টাকা দেওয়া হচ্ছে।” বিমানবাবুর কটাক্ষ, “মনে রাখতে হবে এটা রাজতন্ত্র নয়, গণতন্ত্র!” |