বাসটা কলকাতার পথে রওনা দিতেই কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম ঠুকলেন দাপুটে পুলিশ অফিসারটি। “ভোর চারটে থেকে ডিআইজি কন্ট্রোলের ফোনে জেরবার হচ্ছি। জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত” কোনও রকমে কথাগুলো বলেই থানার মধ্যে সেঁধিয়ে গেলেন দক্ষিণ শহরতলির এক থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই ওসি।
বেসরকারি লগ্নি সংস্থা সারদায় টাকা রেখে ক্ষতিগ্রস্ত ৯২৯ জন আমানতকারীদের নিয়ে সোমবার আগাগোড়া তৎপর ছিল মহাকরণ থেকে সুন্দরবন। সরকারি তহবিল থেকে আমানতকারীদের ক্ষতি পোষানোর অনুষ্ঠানটি ছিল এ দিন দুপুরে, ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ১৪০ জন আমানতকারীর হাতে চেক তুলে দেন। বাকিদের হাতে চেক তুলে দেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং সারদা নিয়ে তদন্ত কমিশনের সদস্য অম্লান বসু। ‘মনোনীত’দের বাড়ি থেকে তুলে এনে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে দেওয়া, আবার ঘরে ফিরিয়ে দেওয়ার যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে। আর সেই দায়িত্বের মধ্যে প্রাতরাশ থেকে মধ্যাহ্নভোজ, বিকেলের জলযোগ থেকে রাতে খাওয়া-থাকা সবই ছিল! |
সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের চেক দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার। ছবি: সুদীপ আচার্য।
|
আয়োজনে কোনও ত্রুটি রাখা হয়নি। দেখে-শুনে এক আমানতকারীর বিস্মিত মন্তব্য, “যত টাকার চেক পেলাম, আয়োজনেই তো তার থেকে বেশি খরচ হল!”
চেক-বিলি উপলক্ষে এ দিন দুপুরে ক্ষুদিরাম অনুশীল কেন্দ্র চত্বর প্রায় মেলার চেহারা নেয়। মহাকরণের নির্দেশে সারদায় ক্ষতিগ্রস্তদের সেখানে আনার জন্য লাগোয়া বিভিন্ন জেলায় আগে থেকেই কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিল পুলিশ-প্রশাসন। যেমন সারদার টাকা নিতে কারা যাবেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৩৪টি থানায় শুক্রবারই সে তালিকা পৌঁছে যায়। তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই শুরু হয় খোঁজ। শনিবার রাত থেকে প্রত্যন্ত এলাকার আমানতকারীদের কাউকে থানার গাড়িতে, কাউকে ভাড়া-গাড়িতে নিয়ে আসা হয়। রাতে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও হয়।
একই ভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরের ৪২ জনকে প্রথমে বিডিও অফিস থেকে গাড়িতে পাঠানো হয় ডিএম অফিসে, পরে বাসে কলকাতায়। হুগলির কোন্নগরের অরবিন্দ রোডের বাসিন্দা দীপঙ্কর দে সকাল থেকে তৈরি ছিলেন। প্রশাসন বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে তাঁকে প্রথমে শ্রীরামপুরের এসডিও অফিসে নিয়ে তোলে। সেখান থেকে ওঁরা ৪৩ জন বাসে চেপে এসেছেন। হাওড়ায় এ জন্য একাধিক জন ‘লিয়াঁজো’ অফিসার ও গাড়ির বন্দোবস্ত ছিল। মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জের মোতিউর রহমানের বাড়িতে রবিবার দুপুরে টাটা সুমো গাড়ি পাঠিয়েছিল জেলা প্রশাসন। তাতে চড়ে বহরমপুর। সেখানে পঞ্চায়েত ট্রেনিং সেন্টারে রাত কাটান ওঁরা ৩৭ জন। সরকারি খরচে খাওয়াও জুটেছে ভাত, ডাল, মাছের ঝোল, পাঁচমিশেলি তরকারি, আলুভাজা, আমড়ার চাটনি। এমনকী, শেষ পাতে পাঁপড় আর মিষ্টিও! |
অনুষ্ঠান শুরুর আগে আমানতকারীদের মধ্যাহ্নভোজ।
সোমবার ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে। ছবি: সুমন বল্লভ। |
আয়োজনে ত্রুটি ছিল না ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রেও। এ দিন দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রের পিছনে টেবিল পেতে রাখা ভাত, ডাল, আলুভাজা, ছ্যাঁচড়া, মাছের কালিয়া, রসগোল্লার বড় বড় গামলা। ক্যাটারিং সংস্থার কর্মীরা পরিবেশন করছেন। দাঁড়িয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারছেন আমানতকারীরা। আছেন সরকারি কর্মী, পুলিশকর্মীরাও। সব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার লোকের ব্যবস্থা। চেক নিতে হাওড়া, বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, নদিয়া এমনকী দার্জিলিং জেলা থেকেও মানুষ এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে অতিরিক্ত জেলাশাসক, এগজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পদমর্যাদার অফিসারেরাও। ক্ষুদিরামেই অনেকের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। তাঁদের প্রাতরাশে ছিল ডিমসিদ্ধ, পাউরুটি, মিষ্টি।
কিন্তু জনগণের করের টাকায় কেন এ ভাবে প্রতারিতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, সেই প্রশ্ন এ দিনও তুলেছে বিরোধীরা। বামেরা এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হওয়ার তোড়জোড় করছে। তাদের দাবি, এই কাজ আইন বহির্ভূতও। বাম নেতাদের মতে, সারদার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে আদালতের নির্দেশ এনে তা নিলামে তুলে আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেত। লিক্যুইডেটর বসিয়ে তা করতে কিছুটা সময় লাগলেও কাজটা যুক্তিসঙ্গত হত। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “সারদা-কর্তা তো বারবার বলেছেন, তাঁর জমিজমা, সম্পত্তি বেচে দায় মেটানো হোক। সরকার করল না! এ দিকে শাসকদলের এক সাংসদ বলছেন, সব ফাঁস করে দেব! কী তদন্ত হচ্ছে, জানি না!” যার জবাবে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, “আইনের মধ্যে থেকেই টাকা ফেরত দিচ্ছি। আমরা মানুষকে ঠকাই না। ফেসবুকে তাঁর মন্তব্য, “আগে কি কখনও শুনেছি যে, চিটফান্ডে প্রতারিতদের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে?”
এ দিনের অনুষ্ঠানে সারদা-কাণ্ড নিয়ে গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান শ্যামলকুমার সেন বলেন, “হাইকোর্টের নির্দেশ ও রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সারদা গোষ্ঠীর সম্পত্তি বিক্রি করেই আমানতকারীদের টাকা মেটানো হবে। অতিরিক্ত টাকা সরকারকে ফেরত দেওয়া হবে।” তিনি জানান, আপাতত ৫০ কোটি টাকা তহবিলে জমা দিয়েছে রাজ্য সরকার। শ্যামলবাবুর বক্তব্যের রেশ ধরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রাজ্য পাঁচশো কোটির তহবিল বানিয়ে দেবে। কালীপুজোর পরে আরও চার-পাঁচ লক্ষ আমানতকারীর টাকা ফেরানো হবে। টাকার কোনও অসুবিধা হবে না।” আশির দশকে সঞ্চয়িতা-কাণ্ডের উল্লেখ করে মমতা বলেন, “পঁয়ত্রিশ বছরেও ওঁরা টাকা পাননি। সারদায় ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরানো আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল।” এই অনুষ্ঠানের আগে এ দিনই নেতাজি ইন্ডোরে দলীয় সভায় সব নেতা-কর্মীকে সতর্ক করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এই সব সংস্থায় কেউ টাকা রাখবেন না। পাঁচ হাজার নেবে। এক হাজার ফেরত দেবে, চার হাজার মেরে দেবে।”
সারদায় টাকা রেখে যাঁরা বিপাকে পড়েছেন, তাঁদের কিছু অর্থ ফেরত দেওয়া যায় কি না, খতিয়ে দেখতে রাজ্য যে কমিশন গড়েছে, তার সুপারিশক্রমেই এ দিন প্রথম পর্যায়ে ওই ৯২৯ জন টাকা পেলেন। এতে সরকারের ব্যয় হল ৪১ লক্ষ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা। পুজোর আগে আরও ১ লক্ষ আমানতকারীর ক্ষতি পোষাতে রাজকোষ থেকে আরও ৪৩ কোটি ব্যয় হবে। অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী জানিয়েছেন, ওই সব চেক জেলাশাসকদের পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে। এ দিন চেক দিতে গিয়ে আমজনতার উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “চিটফান্ডের লোকেরা টাকা নিয়ে ঠিক কাজ করে না। ওদের কাছে না-রেখে বাড়িতে লক্ষ্মীর ভাঁড়ে টাকা রাখুন।” মাসখানেকের মধ্যে রাজ্যই একটি ‘নিরাপদ’ সঞ্চয় প্রকল্প চালু করবে বলেও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু এ দিন আমানতকারীদের আনা-নেওয়া-খাওয়া-রাখায় খরচ হল কত? প্রশাসনের কর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনা পুলিশের এক কর্তা তো প্রশ্ন শুনেই চলে গেলেন অন্য প্রসঙ্গে। আবহাওয়ার কথা পেড়ে বলতে থাকলেন, “আজ বৃষ্টিটা মনে হচ্ছে সারা দিন ভোগাবে......।” |