তৃণমূল মানে আবেগ-নির্ভর দল। এই চেনা পরিচয়ের বাইরে বেরিয়ে লোকসভা ভোটের আগে দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থান নিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সোমবার তৃণমূলের সাধারণ পরিষদের বর্ধিত সভা থেকে তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করলেন, “শৃঙ্খলার প্রশ্নে কোনও আপস নয়। দলের কেউ খারাপ কাজ করলে দল দায়িত্ব নেবে না। কেউ
যদি টাকা তোলে, দল তার দায়িত্ব নেবে না। সে ক্ষেত্রে আইন আইনের পথে চলবে।” অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসন যে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, তার পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছেন মমতা।
দলে কুণাল ঘোষের বিদ্রোহ, সোমেন মিত্রের মতো বর্ষীয়ান সাংসদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি এবং সর্বোপরি সোমেন-জায়া, বিধায়ক শিখা মিত্রের প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে জেহাদের প্রেক্ষাপটে এ দিন মমতা তাঁর ‘দিদি’ ভাবমূর্তি সরিয়ে রেখে এক ঋজু নেত্রীর চেহারা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। পরিষ্কার বলেছেন, “আমাদের দলের অধিকাংশ কর্মীই সুশৃঙ্খল, দলের প্রতি নিবেদিত। যে ০.১% দুষ্টমি করে, তাদের বাদ দিতে হবে! কারণ দলে শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে, দল তৈরির প্রশ্নে আমাদের পার্টি কড়া (‘রাফ অ্যান্ড টাফ’)।” |
প্রণত তাপস পাল। সোমবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে।ছবি: সুদীপ আচার্য। |
শৃঙ্খলার প্রশ্নে দল যে কড়া অবস্থান নিয়েছে, নেতাজি ইন্ডোরের সভার ৪৮ ঘণ্টা আগে কুণালকে সাসপেন্ড করার ঘোষণার মধ্যে দিয়েই তৃণমূল নেতৃত্ব তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। মমতা এ দিন বলেছেন, “কেউ কেউ তৃণমূলের হাত ধরে ভোটে জেতেন। তার পর পাঁচ বছর পরে পেনশন পাওয়ার সময় প্রশ্ন তোলেন, ‘দল বড়, না আমি বড়!’ মানুষই ঠিক করবে কে বড়!”
দলের একাধিক নেতারই মনে হয়েছে, তৃণমূল নেত্রীর এই বক্তব্যের লক্ষ্য ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ সোমেনবাবুই। ইন্ডোরের সভায় এ দিন সোমেনবাবু যাননি। তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পরে সোমেনবাবু বলেন, “উনি তো আমার নাম করে কিছু বলেননি। তবে পেনশন নেওয়ার জন্য আমি তৃণমূলে আসিনি! আমি বিধায়কের নিশ্চিত পেনশন ছেড়েই তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলাম।” তাঁর দাবি, ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্র থেকে জয়ী হওয়ার জন্য দলের যেমন কৃতিত্ব আছে, তাঁর নিজস্ব পরিচয়ও কাজ করেছে। দলের আমন্ত্রণ পেয়েও সভায় উপস্থিত কেন হননি? সোমেনবাবু বলেন, “আসলে প্রথমে ভেবেছিলাম দলের গুরুত্বপূর্ণ সভা। কিন্তু পরে হোর্ডিংয়ের বহর দেখে মনে হল, এটা জনসভা! সেই জনসভায় এক জন মানুষ না গেলে কী এসে গেল!”
দলীয় নেতাদের একাংশের অভিমত, লোকসভা ভোটের আগে রাজ্য স্তরে তো বটেই, জাতীয় স্তরে তৃণমূলের প্রসার ঘটাতেই তৃণমূল নেত্রী সাংগঠনিক প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের ব্যাখ্যা, এ দিন ইন্ডোরের বর্ধিত সভায় দলের সমস্ত শাখা সংগঠনের নেতা, পঞ্চায়েত ও পুরভোটের জয়ী সদস্য যেমন ছিলেন, তেমনই প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, এমনকী উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, সিকিম, মিজোরাম প্রভৃতি রাজ্যের দলীয় প্রতিনিধিরাও ছিলেন। তাঁদের উপস্থিতিতে মমতা সোজাসুজিই বুঝিয়ে দিয়েছেন, সারা দেশের সামনে তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তিনি উপস্থাপিত করতে চান। মমতার কথায়, “মানুষ ভুল বোঝে এমন কোনও কাজ আমাদের কর্মীরা করবেন না।” তিনি ভিন্ রাজ্যের দলীয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এখানকার নেতা-কর্মীদের বলেন, “রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরা, মণিপুর, অসম, বিহার প্রভৃতি রাজ্যের মানুষ আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। সে দিকে লক্ষ রেখে দলের কাজ করুন।”
মমতাই শুধু নন, দলে শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে এ দিন ইন্ডোরে সরব ছিলেন লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংসদ সৌগত রায় থেকে শুরু করে দলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরা। কুণালের প্রসঙ্গে সৌগতবাবু বলেন, “মমতার রাজনৈতিক জীবনে সংগ্রাম ও আত্মত্যাগই বড়। সেখানে দলে কেউ সেই নীতি-আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে তা মমতাকেই অপমানের সামিল।” সৌগতবাবুর সুরেই পার্থবাবুও গুরুত্ব দেন দলীয় শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের উপর। পঞ্চায়েত ও পুরভোটে সাফল্যের নিরিখে দলীয় কর্মীদের আত্মসন্তুষ্টিতে না ভোগার জন্য সতর্ক করেন সুদীপবাবু।
কুণাল বা শিখাদেবীর ইন্ডোরের সভায় যাওয়ার প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু গত ২০ সেপ্টেম্বরে সোমেনবাবুর উপস্থিতিতে কুণাল, শিখাদেবীদের সঙ্গে দলীয় নেতৃত্বের সমালোচনায় সরব হয়েছিলেন দলের অপর দুই সাংসদ তাপস পাল ও শতাব্দী রায়। দু’জনেই দলনেত্রীর কাছে চিঠি লখে ক্ষমা চেয়েছেন। সভা শুরুর অনেক আগেই এ দিন তাপস-শতাব্দী মঞ্চে উঠে বসেছিলেন। মমতাকে অবশ্য তাঁদের সঙ্গে কোনও কথা বলতে দেখা যায়নি। তবে তিনি যখন স্লোগান দিচ্ছিলেন, তখন অন্যদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন তাপস-শতাব্দীও। সভা শেষ করে মমতা যখন মঞ্চ থেকে নামতে যাবেন, তখন তাপস তাঁকে প্রণামও করেছেন। মমতা অবশ্য অন্য নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দ্রুত মঞ্চ থেকে নেমে গিয়েছেন।
দলে বিক্ষুব্ধদের যেমন কড়া হাতে মোকাবিলা করা হবে, তেমন গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বকেও কোনও ভাবে প্রশ্রয় না দেওয়ার কথা মমতা এ দিন স্পষ্টই বলেছেন। তাঁর কথায়, “দলে আমি, না সে বড়, দেখার দরকার নেই। লক্ষ্মণের গণ্ডি রেখা থাকা দরকার। কেউ কারও গণ্ডি পেরোবেন না।” দলের সদ্য জয়ী পুরসভা, পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদের সদস্যদের তিনি সতর্ক করে বলেন, “যখন কোনও কাজ করবেন, তখন দলের সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে নেবেন। কারণ, আপনাদের কাজের উপরে দলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।”
পঞ্চায়েত ভোটে যে সমস্ত জেলায় ভাল ফল হয়েছে, সেখানে সংগঠনকে আরও ভাল করে গড়ে তোলার নির্দেশ দেন তিনি। আর যে সমস্ত জেলায় ফল ভাল হয়নি, সেখানে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন করার জন্য আবেদন জানান। বিশেষত, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়িতে সংগঠন মজবুত করার কাজ শুরু করতে বলেছেন তিনি। মুকুল রায়, সুব্রত বক্সী, শুভেন্দু অধিকারী প্রমুখ নেতাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠন দেখভালের দায়িত্বও তৃণমূল নেত্রী দিয়েছেন। পুজোর পর থেকেই ২৫ নভেম্বরের ব্রিগেড সমাবেশের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যে এ দিন মমতা নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সভার প্রচারকে সামনে রেখে কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এলাকায় এলাকায় জনসচেতনা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “এ সবই লোকসভা ভোটকে সামনে রেখেই নেত্রীর কর্মসূচি।” |