উত্তর ২৪ পরগনার প্রধান সীমান্ত শহর বনগাঁর শারদোৎসব গত কয়েক বছর ধরেই থিম বৈচিত্র্যে ভরপুর। আর সেটা এমনই যে জেলা লাগোয়া শহরাঞ্চলের মানুষও এখানকার পুজো দেখতে ছুটে আসেন। পুজোর সেই সব দর্শনার্থীদের কথা মাথায় রেখে এ বছরেও দুর্গার আবাহনে কোনও ত্রুটি রাখতে চান না বনগাঁর পুজো উদ্যোক্তারা। সেইমতো মণ্ডপ থেকে আলোকসজ্জা সবেতেই কোমরবেঁধে নেমে পড়েছেন তাঁরা। মাঝেমধ্যে শরতের নীল আকাশকে কালো কাপড়ের মধ্যে বিধাতা লুকিয়ে ফেললেও উদ্যোক্তাদের আশা দেবীর কৃপায় পুজোর চারদিনেই বাজিমাত করবে আকাশ। |
যদিও ২০০০ সালের পরে বনগাঁর মানুষ আকাশকে একটু সমঝেই চলেন পুজোর সময়। কারণ সে বছর ভয়াবহ বন্যার কবলে পুজোর আনন্দ ভেসে গিয়েছিল বনগাঁবাসীর। তারপর প্রতি বছর পুজোর আগে বৃষ্টি ও রোদের লড়াইয়ে অভ্যস্ত এখানকার মানুষ মহালয়ার পর থেকে পুজোর মাঠে নেমে পড়েন। শুরু হয় পুজোর ফ্যাশন, কেনাকাটা। পুলিশ-প্রশাসনের হিসাবে জেলার অন্যতম এই সীমান্ত মহকুমা শহরে পুজোর সংখ্যা ৫০টিরও বেশি। বড় ও মাঝারি মাপের পুজো ২৬টি।
বনগাঁ শহরের বিখ্যাত পুজোগুলোর মধ্যে লোক টানার প্রতিযোগিতায় অবশ্য সামনের সারিতে থাকবে ১২-র পল্লি স্পোর্টিং ক্লাব। রামনগর রোডের ধারে দেখা গেল নানারকম ফলের খোলা, আঁটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির শিল্পীদের হাতে ধীরে ধীরে পূর্ণতা পাচ্ছে ৭০ ফুট উঁচু এই মণ্ডপ। চন্দননগরের আলোকশিল্পীদের উপহার হিসাবে থাকবে পুরীর জগন্নাথ মন্দির। থাকবে নানা রকমের মডেল। যশোহর রোডের ধারে আচমকা বেঙ্গালুরুর লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির দেখে চমকে উঠতে পারেন অনেকেই। পুজোয় দর্শনার্থীদের জন্য এমনই চমক হাজির করতে চলেছে অভিযান সঙ্ঘ। বাড়তি পাওনা মুম্বইয়ের ইন্ডিয়া গেট। পুজোয় অভিযাত্রী নামে এঁদের একটি শারদীয়া পত্রিকাও প্রকাশিত হচ্ছে।
বনগাঁ-চাকদহ সড়কের ধারে তিনটি পুজো এ বার দর্শকদের চোখ টানবে। জাগ্রত সঙ্ঘ নদিয়ার মায়াপুরের চন্দ্রোদয় মন্দিরের আদলে তৈরি করছে ১২০ ফুট উঁচু মণ্ডপ। সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে ছোটদের আনন্দ দিতে তৈরি মিকিমাউস। রেটপাড়া স্পোর্টিং ক্লাব পাহাড়ের উপরে তৈরি করছে মন্দির। এখানে অবশ্য প্রতিমা দর্শন করতে হলে পাহাড়ের গা বেয়ে ১০০টি সিঁড়ি ভাঙতে হবে দর্শনার্থীদের। টেরাকোটার দেবীদর্শনের পথেই চোখে পড়বে পাহাড়ি ঝরনা। শারদীয় সাহিত্যে এঁরাও হাজির থাকবেন নিজেদের প্রকাশনা ‘কণিষ্ক’ নিয়ে। আলোয় এঁদের উপহার ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’। প্রতাপগড় স্পোর্টিং ক্লাবের মণ্ডপ এ বার অভিনবই বটে। বৃন্দাবন, মায়াপুর এবং কাশী এই তিন জায়গার মন্দিরের স্থাপত্য নিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। মণ্ডপে দেখা যাবে শিবের নানা রূপ। তাজমহল, মহাকরণ থাকছে এঁদের আলোয়। |
রেটপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবের নির্মীয়মাণ মণ্ডপ। |
মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টাওয়ারের অনুকরণে গেট তৈরি করে আলোয় বাকিদের পিছনে ফেলে দেওয়ার চেষ্টায় নিরলস খেটে চলেছেন মতিগঞ্জ ঐক্য সম্মিলনীর শিল্পীরা। খাজুরাহোর বিষ্ণুমন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠ ও পিতল। পুজোয় প্রকাশিত হবে এঁদের পত্রিকা ‘ঐকান্তিক’। বনগাঁ-বাগদা রাস্তার পাশে ওড়িশার ধবলগিরি পাহাড়টাকেই তুলে এনেছেন এগিয়ে চলো সঙ্ঘের পুজোর উদ্যোক্তারা। মণ্ডপের মধ্যে তিনশো বুদ্ধ মূর্তির মাধ্যমে তাঁর জীবনকাহিনী জানতে পারবেন দর্শনার্থীরা। এখানে প্রতিমা তৈরি করছেন নন্দীগ্রামের শিল্পী সত্য কাজুরি। গোপালনগর ফ্রেন্ডস কর্নার পুজোর আয়োজনে তেমন পুরনো না হলেও মণ্ডপ তৈরির বৈচিত্র্যে এ বারও যে তাঁদের দিকে নজর রাখতে হবে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। চাকদহ রোডে দিল্লির দুর্গামন্দির নজর কাড়বে। ‘বৃষ্টি’ নিয়ে শারদীয় সাহিত্যে এঁরাও হাজির থাকছেন। আমলাপাড়া অ্যাথলেটিক ক্লাবের থিম ছোটদের বহুপঠিত কবিতা আগডুম-বাগডুম। মাটির পাত্র আর খড়-বিচালির মণ্ডপ। বাউল গ্রাম নিয়ে পুজোয় হাজির হচ্ছে পূর্বপাড়া প্রগতি সঙ্ঘ। দেখা মলবে ফকিরেরও। এই সব মণ্ডপের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে এক ঝলক দেখে নেওয়া যেতে পারে সোনালি স্পোর্টিং, বলাকা সমিতি, শক্তিগড় মিলন সঙ্ঘ, জ্ঞানবিকাশিনী সঙ্ঘ,পূর্বপাড়া যুবকবৃন্দ, নোবেল স্পোর্টিং, রামনগর স্পোটিং, সুভাষনগর সেবাসমিতির পুজো।
কে বলতে পারে বিশাল বিশাল মণ্ডপের মধ্যেই হঠাৎ কোনও নাম না জানা শিল্পীর হাতের জাদু আপনার মন কেড়ে নেবে না! |
ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক। |