টানা চার মাস ধরে চলছিল সংঘাতের আবহ। অবশেষে প্রতিবাদী কামদুনির দিকে শান্তির হাত বাড়িয়ে দিল রাজ্য সরকার।
উপলক্ষ একটি রক্তদান শিবির। কামদুনির প্রতিবাদী মঞ্চের পাল্টা হিসেবে গড়ে ওঠা তৃণমূল-প্রভাবিত কামদুনি শান্তিরক্ষা কমিটির তরফে রবিবার এই শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে উপস্থিত ছিলেন প্রতিবাদী মঞ্চের সম্পাদিকা মৌসুমী কয়াল-সহ কয়েক জন সদস্য। তাঁদের সামনেই রাজ্যের মন্ত্রীরা সংঘাত ছেড়ে উন্নয়নের পথ ধরার আহ্বান জানান। ‘রাগ-বিদ্বেষ’ ভুলে গিয়ে প্রতিবাদী মঞ্চকেও সেই কর্মকাণ্ডে সামিল হওয়ার ডাক দেওয়া হয়। মঞ্চের তরফেও এ দিন সরকারের সঙ্গে নতুন করে বিরোধিতায় না-যাওয়ারই ইঙ্গিত মিলেছে। শান্তির আহ্বান অতএব বিফলে যাবে না বলেই আশা করছে প্রশাসন।
রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, কামদুনি-সমস্যা যে গলার কাঁটার মতো বিঁধে থাকছে, সেটা কিছু দিন ধরেই বুঝতে পারছিলেন সরকারের শীর্ষ নেতারা। আবার প্রতিবাদী মঞ্চের নেতারাও বুঝতে পারছিলেন, সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে লাভ নেই। সংঘাত এড়িয়েও দোষীদের বিচার ও এলাকার উন্নয়নের দাবিতে অনড় থাকা সম্ভব। দু’পক্ষের এই বোধোদয়ই এ দিন রক্তদান শিবিরকে উপলক্ষ করে পরস্পরকে কাছাকাছি এনে দিল বলে মনে করা হচ্ছে। এ দিন কোনও পক্ষের কথাবার্তাতেই আগের সংঘাতের মেজাজ দেখা যায়নি।
সম্প্রতি নিহত ছাত্রীর পরিবার সরকারি চাকরি ও ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করে গ্রাম ছাড়ার পরে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল কামদুনিতে। এ দিন মৌসুমীদের পাশাপাশি রক্তদান শিবিরে ছিলেন নিহত ছাত্রীর বাবা। তদারকিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় তাঁর দুই ভাইকেও। ছিলেন ঘটনার অন্যতম মূল অভিযুক্ত আনসার আলির ভাই আরশাদ আলি ও তাঁর পরিবারের কয়েক জনও। এ ভাবে সকলকে একজোট করে প্রতিবাদীদের শান্তির বার্তা দেওয়াটা পুজোর মুখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ বলেই মনে করা হচ্ছে। |
সরকারের তরফে এ দিনের শিবিরে ছিলেন শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু, পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। এসেছিলেন বারাসতের বিধায়ক চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী-সহ তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বও। গত ৭ জুন রাতে ধর্ষিত-নিহত ছাত্রীর দেহ উদ্ধার হওয়ার পর দিনই কামদুনিতে গিয়ে জনরোষের মুখে পড়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। এ দিন কিন্তু কামদুনিতে মন্ত্রীরা ‘গো-ব্যাক’ ধ্বনি কিংবা প্রতিরোধ-অবরোধের বদলে পাশে পেয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশকে।
যেখানে এই শিবিরের আয়োজন করা হয়, সেই মাঠেই এত দিন সভা করেছে প্রতিবাদী মঞ্চ। এ দিন সেখানে দাঁড়িয়েই মন্ত্রীরা ঘোষণা করলেন, উন্নয়নের কথা। দোষীদের কড়া শাস্তির দাবিতেও তাঁরা সরব হন। জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, “দোষীদের বিচার ও এলাকার উন্নয়ন একই সঙ্গে হবে।” নিহত ছাত্রীর বাবা এ দিন বলেন, “মন্ত্রীদের আশ্বাস শুনে মন কিছুটা শান্ত হচ্ছে।”
অনুষ্ঠানে হাজির থাকলেও কোনও রাগ-প্রতিবাদের কথা বলেননি প্রতিবাদ আন্দোলনের অন্যতম মুখ মৌসুমি। কেন অনুষ্ঠানে এলেন, এই প্রশ্নের উত্তরে মৌসুমি বলেন, “আমাকে চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। পাড়ায় রক্তদানের মতো একটা ভাল কাজ হচ্ছে, তাই এসেছি।” এই অনুষ্ঠানে আসাটা কি তাঁর তরফে কোনও সমঝোতার ইঙ্গিত? জবাব দেননি মৌসুমি।
ঘটনা হল, মৌসুমিরা কয়েক জন এলেও প্রতিবাদী মঞ্চের সভাপতি ভাস্কর মণ্ডল (যাঁর বাড়িতে বৃহস্পতিবার হানা দিয়েছিল পুলিশ), গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায় কিংবা আর এক প্রতিবাদী চরিত্র টুম্পা কয়ালকে এ দিনের অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। তবে সরকার যে সংঘাত ছেড়ে কামদুনির সকলকে নিয়ে একসঙ্গে চলতেই আগ্রহী, সে কথা মন্ত্রীরা এ দিন স্পষ্টই বুঝিয়ে দেন। রাজ্যের ক্রীড়া ও পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র সরাসরি বলেন, “কারও উপরে রাগ-বিদ্বেষ নয়, প্রতিবাদী মঞ্চকেও পাশে চাই।” অনুষ্ঠানের ফাঁকে স্থানীয় ক্লাবগুলিকে অর্থসাহায্য দেওয়ার কথা ও এলাকার পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নতির কথাও বলেন মদনবাবু। তৃণমূলের পক্ষ থেকে জেলা পরিবহণের দায়িত্বে থাকা গোপাল শেঠ জানান, শীঘ্রই রাজারহাট থেকে কামদুনি হয়ে মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত অটো ও ম্যাক্সি-ট্যাক্সি চালু হবে।
অনুষ্ঠানের পরে ব্রাত্য এবং জ্যোতিপ্রিয় দু’জনেই আলাদা করে বলেন, সরকার চায় কামদুনিতে শান্তি ফিরুক। গত চার মাস ধরে লাগাতার যে চাপানউতোর এবং সংঘাত চলেছে, তার শেষ হোক। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাই-ই চান। বক্তৃতা মঞ্চ থেকেও তাই ব্রাত্যবাবু মনে করিয়ে দেন, “সংঘাতের চেয়ে অস্ত্র হিসেবে উন্নয়ন অনেক ভাল।”
চার মাস আগে কামদুনির কলেজছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর এলাকায় ঢুকতে গিয়ে জ্যোতিপ্রিয়র পাশাপাশি বাসিন্দাদের তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ হাজি নুরুল ইসলাম। দু’জনেই এলাকায় ঢুকতে না পেরে ফিরে যান। পরবর্তী কালে গ্রামে গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন মুখ্যমন্ত্রীও। সিআইডি-র তদন্তের উপরে অনাস্থা প্রকাশ করে রেল প্রতিমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর ব্যবস্থাপনায় কামদুনির বাসিন্দারা বিচার চাইতে যান রাষ্ট্রপতির কাছে। গড়ে ওঠে কামদুনি প্রতিবাদী মঞ্চ।
এর পর আদালতে মামলা শুনতে এসে পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে জড়িয়ে পড়েন নিহত ছাত্রীর কাকা বিমল ঘোষ। পরবর্তী কালে তিনি মারাও যান। কিন্তু সম্প্রতি নিহত ছাত্রীর পরিবার প্রতিবাদের পথ থেকে কিছুটা সরে আসে। রাজ্য সরকারের কাছ থেকে চাকরি-ক্ষতিপূরণ নেওয়ার পাশাপাশি প্রতিবাদী মঞ্চের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম-সহ বিভিন্ন অভিযোগও তোলেন তাঁরা। এই নিয়ে ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কামদুনি। প্রতিবাদী মঞ্চের দুই সদস্যের নামে এফআইআর দায়ের করে পুলিশ।
এই সব ঘটনাপ্রবাহ কামদুনিকে ফের অশান্ত করে তুলবে, এমন আশঙ্কা যখন তৈরি হচ্ছিল, তখনই শান্তির জন্য উদ্যোগী হল সরকার। রাজনৈতিক-প্রশাসনিক শিবিরের অনেকেই যাকে মমতার তরফে পরিণত এবং ইতিবাচক ভূমিকা হিসেবেই বর্ণনা করছেন।
এ দিন কামদুনির ১২০ জন বাসিন্দা শিবিরে রক্তদান করেন। রক্ত দিয়ে বেরিয়ে এসে গ্রামের এক মহিলা বলেন, “আমরা অশান্তি চাই না। ঘটনার পর থেকে গ্রামে ঝড় বয়ে গিয়েছে। এ বার তা শেষ হোক।” |