পুরভোটের ময়দান ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্তে দলের অন্দরে ঝড় বইছে! সেই ঝড়ের রেশ পৌঁছেছে দিল্লিতে পলিটব্যুরো বৈঠকেও। প্রবল সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত ঈষৎ সুর নরম করলেন সিপিএমের বর্ধমান জেলা নেতৃত্ব। শাসক দলের সন্ত্রাসকে দুষলেও তাঁরা মেনে নেন, নিজেদের সংগঠনে ঘুণ ধরেছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গেলে সংগঠনকে ঢেলে সাজা দরকার।
পঞ্চায়েত ভোটে ভরাডুবির পর থেকেই বর্ধমানে জেলা নেতৃত্বে রদবদলের জোরালো দাবি উঠছে দলের অভ্যন্তরে। পুরভোটের দিন বর্ধমানে প্রার্থী প্রত্যাহারের ঘোষণা সেই বিতর্কে আরও ঘৃতাহুতি দিয়েছে। এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে তাঁদেরই জেলার দু’টি পুস্তিকার শারদসংখ্যায় কলম ধরে বর্ধমানের প্রথম সারির নেতারা যা লিখেছেন, তাকে যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ বলে ধরতে হবে!
পুরভোটের দিন বুথে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের লোকজন যে ভাবে মানুষকে তাদের দিকে ভোট দিতে বাধ্য করেছিল, তার পরে ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার আর কোনও অর্থ ছিল না বলে প্রত্যাশিত ভাবেই সওয়াল করেছেন সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদার। তাঁর যুক্তি, ‘গণতন্ত্রের সম্ভ্রম রক্ষা করতে’ই ভোট বয়কটের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। প্রতিরোধে গিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের হারানো এবং সাধারণ মানুষকে অশান্তিতে ফেলার ঝুঁকি তাঁরা নিতে চাননি। ‘পৃথিবীর সামনে ফ্যাসিস্ট শক্তির আসল রূপটাকে বে-আব্রু’ করে দেওয়ার লক্ষ্যে তাঁদের ওই সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তকে যাঁরা সমর্থন করছেন, তাঁদের ধন্যবাদও জানিয়েছেন জেলা সম্পাদক! কিন্তু একই সঙ্গে মেনে নিয়েছেন, ‘যে মানুষ আমাদের থেকে দূরে রে গিয়েছিলেন, সেই সমর্থনকে ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত করতে হবে। সে জন্য চাই সগঠন। একটি শক্তিশালী ও সবল সংগঠন গড়ে তোলাই আমাদের সামনে এখন সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ’।
কিছু দিন আগে পর্যন্তও যে জেলাকে সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি বলা হত, সেখানেই শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলাকে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ধরে এগোতে হচ্ছে জেলা সম্পাদকের এমন বার্তাকে যথেষ্ট অর্থবহ বলেই মনে করছে সিপিএমের একাংশ। আবার আরও খোলাখুলি স্বীকারোক্তি এসেছে দলের রাজ্য কমিটির সদস্য তথা বর্ধমানের নেতা রথীন রায়ের কাছ থেকে। তৃণমূলের যাবতীয় অপকর্ম ও সন্ত্রাসের বিবরণ পেশ করেও যিনি অন্য একটি শারদসংখ্যায় লিখেছেন, ‘কিন্তু অন্ধকারের দিকও আছে। প্রায় ২৫-৩০% পার্টি সদস্য কোনও কাজই করেননি! নিরাপদ দূরত্বে বসেছিলেন। কিছু কিছু শান্তি ক্রয় করেছেন। তথ্য দিয়ে এবং নানা ভাবে। এই বোঝা কেন সংগঠন বহন করবে’? দেখতে স্ফীত হলেই সংগঠন যে কার্যকর হয় না, তার সাম্প্রতিক উদাহরণের প্রেক্ষিতেই রথীনবাবুর সওয়াল, ‘...সংগঠনকে ঢেলে সাজতে হবে। যে সংগঠন প্রত্যেকটি বাঁক ও মোড়ের মুখে যথাযথ নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে’। বস্তুত, পুরভোট-জনিত দলের মধ্যেকার বিতর্ক এখন পলিটব্যুরো স্তরেও আলোড়ন তৈরি করেছে। যে কারণে পলিটব্যুরোর এক সদস্য বলছেন, “বর্ধমানের ঘটনার পরে আমাদের একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে লোকসভা ভোটের আগেই। তৃণমূলের কাছে আত্মসমর্পণ না পাল্টা প্রতিরোধ, কোনটা আমাদের পথ হবে?” এই সার্বিক বিতর্কের আবহেই বিরাটিতে সিপিএমের রাজ্য কমিটির আয়োজিত ছাত্র ফ্রন্টের কর্মশালা দলের একাংশের নজর টেনেছে। তিন দিনের ওই শিবিরে ক্লাস নেওয়ার জন্য বিমান বসুরা রাখেন বর্ধমানের অরিন্দম কোঙার, পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক দীপক সরকারকে। যাঁরা সচরাচর ছাত্র ফ্রন্টের কাজের সঙ্গে জড়িত নন এবং যে দু’টি জেলা এই মুহূর্তে রাজ্য দলে কোণঠাসা। প্রশ্ন উঠেছে, তাঁদেরই ছাত্র শিবিরে হাজির করে বিমানবাবুরা কী দলেই কোনও পাল্টা বার্তা দিতে চাইলেন? |