দূরের গ্রাম থেকে ঢাকের শব্দ ভেসে এলেই মন খারাপ হয়ে যেত গ্রামবাসীর। ব্যাজার মুখে ভাবতেন, নিজেদের গ্রামেও এমন একটা পুজো হলে খারাপ হত না। কিন্তু দুর্গাপুজো করতে হলে সময়, পরিশ্রম বা নিয়মনিষ্ঠা তো আছেই, প্রয়োজন ট্যাঁকের জোরেরও। এ সব সাতপাঁচ ভেবেই এত দিন পুজোর গুরুদায়িত্ব কাঁধে তোলার রাস্তায় হাঁটেননি কুলটির চলবলপুরের মানুষজন। অবশেষে গা ঝাড়া দিয়ে এ বার তাঁরা নেমে পড়েছেন পুজোর ময়দানে।
কুলটি পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের এই চলবলপুরে এখন প্রায় সাড়ে চারশো পরিবারের বাস। এত মানুষজন থাকলেও এলাকায় কোনও দুর্গাপুজো না হওয়ায় খেদ ছিল গ্রামবাসীর। গ্রামের আশপাশে চার কিলোমিটারের মধ্যে অন্য কোনও গ্রাম নেই। তাই পুজোর সময়ে অঞ্জলি দিতে বা ঠাকুর দেখতে নিয়ামতপুর, সালানপুর, বড়িরা, মেলেকোলায় যেতে হত তাঁদের। দুর্ভোগে পড়তেন মহিলা ও শিশুরা। বাসিন্দারা জানান, এ ছাড়াও অন্য গ্রামে পুজো দেখতে গিয়ে নিজেরা এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগতেন। বারবার মনে হত, নিজেরাও একটা পুজো করতে পারলে বেশ হয়।
অবশেষে এ বছর পুজো হচ্ছে চলবলপুরে। গ্রামে পুজো করার সিদ্ধান্ত হল কী ভাবে? বাসিন্দারা জানান, এ ব্যাপারে উদ্যোগী হন এলাকার কয়েক জন তরুণ। গ্রামে ঢোকার মুখে বাঁকের কাছে রাস্তা যেখানে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে, সেখানে এক চাতালে বসে গল্পগুজব করার সময়ে এ নিয়ে কথাবার্তা হয় তাঁদের মধ্যে। সিদ্ধান্ত হয়, গ্রামে দুর্গাপুজো হবে। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে একটি গ্রামবাসীদের নিয়ে সভা ডাকা হয়। পুজো করার প্রস্তাবে দু’হাত তুলে সমর্থন জানান প্রবীণেরা। এমনই এক প্রবীণ বাসিন্দা ষষ্ঠীপদ গড়াই বলেন, “ছেলেগুলো সত্যিই এমন কাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে, ভাবতে পারিনি। গ্রামের মাটিতে দুর্গাপুজো হবে, সেটাই আমাদের কাছে ভীষণ আনন্দের খবর।” গ্রামের বহু তরুণ কর্মসূত্রে ভিন্ রাজ্যে রয়েছেন। প্রতি বছর পুজোর ছুটিতে গ্রামে ফেরেন তাঁদের অনেকে। অমিত মুখোপাধ্যায় নামে এমনই এক জন ওড়িশা থেকে ফোনে বলেন, “পুজো বাড়ি গিয়ে ঠাকুর দেখতে সেই পাশের গ্রামে ছুটতে হত। নিজের গ্রামে পুজো দেখতে পাব শুনে খুব আনন্দ হচ্ছে। কয়েক দিন আগেই ফিরব এ বার।”
দিনরাত এক করে পুজোর আয়োজনে মেতেছেন গ্রামের ৬২ জন তরুণ-তরুণী। পুজো কমিটির সম্পাদক দীনেশ গড়াই জানান, প্রথম বছরের পুজোতেই গ্রামকে মাত করে দিতে চান তাঁরা। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের দিয়েই পুজোর সূচনা করানোর চেষ্টা চলছে, জানান তিনি। মিঠুন মুখোপাধ্যায় বলেন, “এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে নতুন জামাকাপড় কেনার সময় পাচ্ছি না।” দেবজিৎ গড়াইয়ের কথায়, “দুর্গাপুজো করা কি মুখের কথা! তবে প্রথম বছর আমরা পান থেকে চুন খসতে দেব না।” শুকদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, “এ বার অন্য গ্রামের লোকজনকে আমাদের পুজোয় আসার নিমন্ত্রণ জানিয়েছি।” পুজোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায় বলেন, “অনুষ্ঠানে কী চমক থাকছে, তা গোপনে রেখেছি। তবে বলতে পারি, প্রথম বছরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বহু বছর মানুষের স্মরণে থাকবে।” এই পুজো কমিটির সম্পাদক দীনেশ গড়াই জানিয়েছেন, রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের দিয়েই তাঁরা প্রথম বছরের পুজোর সূচনা করতে চান। সেই চেষ্টা চলছে জোর কদমে। |