বাবুরা আজকাল বড় ‘সিয়ানা।’ ষষ্ঠীর আগে কাপড়খানা দিতি চায় না। তার পর থেকে যদি কামাই হয়!
ট্রেন ধরতে হবে। লাইনের উপর তাই সারি দিয়ে বসে আছেন নানা বয়সের ‘মাসি।’ অন্য দিনের মতো। কলকাতার শহরতলির বিভিন্ন মুলুকে কাজ শেষে এই ট্রেনটি ধরেই নিত্য বাড়ি ফেরা। প্রায় সবারই বাড়ি বারাসত-বসিরহাট লাইনে। তাই ৩টে ৪০-এর আপ হাসনাবাদ লোকালের নাম ভুলে গিয়ে বারাসতের রেল কর্মীরাও বলে ফেলেন, ‘‘কাজের মাসিদের ট্রেনের কথা বলছেন?’’
তবে আজ একটু অন্য রকম। এই দিনটির জন্যই যেন বছরভর অপেক্ষা। অবশেষে শাড়ি হয়েছে। হাসি হাসি মুখে সেই শাড়ি একে অন্যকে দেখাচ্ছেন মাসিরা। কারও একটা, কারও দুটো, সর্বোচ্চ চার। বেশির ভাগই ছাপা শাড়ি, তাঁত। ডুরে পাড়। হয়তো এ বারও বাবুদের ঘাটতি বাজেটে যত দূর সম্ভব কম পয়সায়, দোকানে গিয়ে সবচেয়ে কম সময়ে পছন্দের শাড়ি। অথচ প্রতীক্ষা শেষে সেই শাড়িটা নিয়েই পুজোর হইচই আর আনন্দ আজ সবচেয়ে বেশি। ‘‘দেখি তোরটা?’’
ভাসিলার আশা দাস বলেন, ‘‘কমা শাড়ি? আমরা লোকের বাড়ি কাজ করি। দামি ভাল শাড়ি আমাদের মানায়? কাপড়টা তবু শক্ত চাই। যাতে না ছিঁড়ে যায়।”
কমপক্ষে ছয় মাস কাজ না-করলে শাড়ি মেলে না। এটাও নিয়ম। পারুলিয়া গ্রামের লক্ষ্মী দাস বলেন, “আমাকে তো ফ্ল্যাট থেকে বলল, তিন মাস হয়েছে। কাপড় হবে না। কাজ না-করলে আবার অন্য লোক দেখে নেবে। এ কাজে লোক তো দিন দিন বাড়ছে।” আবার কেউ কেউ আছেন অন্য রকম। খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে দীপা মণ্ডল বলেন, “আমার বাড়ি বল হেভি ভাল। শাড়িডা পছন্দ হয়েস। শায়া, ব্লাউজ, আলতা, সিঁদুরও দিয়েস।” |
কারও স্বামী নেই, ছেলেপুলে আছে। কারও স্বামী অসুস্থ। কারও আবার ভ্যান চালিয়ে বা ভাটা-ভেড়িতে কাজ করে যা আয়, তাতে সংসার চলে না। অগত্যা, সৎ পথে থেকে শাখা সিঁদুর বাঁচিয়ে এই আয়। রাত দুটোয় ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয় প্রায় সবাইকে। হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ঝাঁটা মেরে, গুল-ঘুঁটে দিয়ে আঁচ ধরিয়ে ভাত আর যা হোক একটা তরকারি রেঁধে, স্নান করে একটু খেয়ে রাত সাড়ে তিনটের মধ্যে ট্রেন ধরতে বেরিয়ে পড়া। বৈরা গ্রামের মালতী সর্দার বলেন, “আমার বাড়ি থেকে স্টেশনে হেঁটে আসতে লাগে আধ ঘণ্টা। তার পর ট্রেন ধরে বারাসত। আবার হেঁটে বাবুদের বাড়ি ঢুকতি তায় দেরি হয়ে যায়।” পাশ থেকে টিপ্পনি, “পয়সা বাঁচাতে হাঁটি। সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে ঢুকি যাই। তাও এক দিনও দরজা খুলে হাসি মুখ দেকতি পাই না।”
ঠিকে ঝিদের এক বাড়িতে মাসকামাই আড়াই থেকে তিনশো টাকা। রান্নার কাজে পাঁচশো থেকে হাজার। গড়ে প্রত্যেকের রোজগার মাসে সাতশো থেকে বারোশো টাকার মতো। যন্ত্রের মতো বাড়ি বাড়ি পাক দিয়েও এর বেশি হয় না। পুজোর সময় মাইনের অর্ধেক টাকা। আবার কোনও কোনও বাড়িতে বখশিস মেলে। তিনটে বাড়িতে কাজ করেন আরতী গাইন। তিনি বলেন, “এক-দুটো শাড়ি হয়ে গেলে আমরা অন্য বাড়িতে শাড়ি না-নিয়ে দাম ধরে নিই। ওই টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের জামা কিনে দিই।”
আচ্ছা, অঞ্জলি দেবেন না?
হাসি সমস্বরে।
স্বামী, ছেলেমেয়ে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বের হবেন না?
আবার হাসির রোল।
অন্য সবার মতো পুজোয় দুটো দিন ছুটি নেন না কেন?
বসিরহাটের মালতীপুরের স্বামী বিচ্ছিন্না সন্ধ্যা বিশ্বাস হাসতে হাসতে বলেন, “তবে দেখতি হবে না। ও দু’দিন দুধ জ্বাল দে দে ক্ষীর বানায় রেখে দেবেনে। গেলিই মুখে ঢেলে দেবে। বলবেনে, ছুটি নেছো, কত্ত কষ্ট। খাও খাও...”।
ফের হাসির রোল, “মাসি রাইট কথা বলিচে।”
এর পরেই দে ছুট। সিগন্যাল হলুদ হয়ে যায়। আবার কালকে। |