|
|
|
|
|
|
|
একটাভয়কষ্টলজ্জা[ঘেন্না] |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
|
হাত জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। তবু মুখে কুলুপ, আসন্ন ঝাড়ের আশঙ্কায়। মা বকবে, বকবেই। এবং ঢুকতেই ঘপাৎ, ‘এ কী! ওড়না দিয়ে হাত ঢেকে রেখেছ কেন? কী হয়েছে দেখি?’ অগত্যা ওড়না সরিয়ে পোড়া হাতটা দেখালাম। এম এসসি ফাইনাল, প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার সময় হাতে চলকে গেল ডাইলুটেড অ্যাসিড। পরীক্ষা শেষের পথে জ্বলুনির চোটে দেখলাম ডান হাতটা অদ্ভুত ভাবে পুড়েছে অ্যাসিডে। হাতের চেটোতে অনেকটা বাদামি দাগ। আর হাতের কবজি বেয়ে ভেতর দিকটায় ঠিক যে ভাবে অ্যাসিড গড়িয়েছে, সেই পথ ধরে চামড়াটা বাদামি হয়ে গিয়েছে।
মা তো হাতে প্রথমেই বরফ ধরে বকুনি দিল, ‘এই তোমার কিচ্ছু খেয়াল না করে কাজ করার ফল। এখন বোঝো কী হবে, দাগ হয়ে যাবে, চামড়া জ্বলে যাবে।’ আমার কিছুই করার নেই। ডাক্তারের কাছে গেলাম, ওষুধ দিল। কিন্তু হাতটা খোলাই রাখতে বলল। আমি ক’দিন বাড়ি-বন্দি।
তার পর ভারী আশ্চর্য একটা জিনিস হতে থাকল। একটা একটা করে ঘণ্টা যায়, আর আমার হাতের যেখানটা পুড়ে গিয়েছিল, সেই বাদামি চামড়ার ভেতরে অসংখ্য জল-ফোসকা উঠতে থাকে। শক্ত মতো। এক সঙ্গে সহস্র সহস্র। চাপ, জমাট বাঁধা, থকথকে। বিভিন্ন সাইজের। একটার সঙ্গে একটা লাগা। ওপরের চামড়াটা খুব শক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু চামড়ার তলা দিয়ে হাজার হাজার ছোট ছোট ফোসকা দেখা যায়।
কী বলব, আমার যে কী ঘেন্না করত! কিন্তু প্রায় অবসেস্ড-এর মতো তাকিয়ে দেখতাম সারা দিন। মাঝে মাঝে মিশমিশ করে উঠত। কিন্তু চুলকে দেওয়া যেত না। কেমন একটা চাক মতো হয়ে ছিল। আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না আমার নিজের হাত এ রকম বীভৎস, ভীষণদর্শন হতে পারে! তীব্র ঘেন্না হত, কিন্তু চোখ সরাতে পারতাম না। মনে মনে ভাবতাম, মানুষ নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কি এ রকম প্রাণপণ ঘেন্না করতে পারে? কিন্তু সত্যি বলছি, আমার ঠিক ওই রকমই মনে হত। কখনও মনে হত একটা ছুঁচ দিয়ে গেলে দিই ফোসকাগুলো। আবার ভাবতাম থাক, এই যে একটা গা-ঘিনঘিনে ব্যাপার আমার শরীরের মধ্যে রয়েছে আর আমি এটার সঙ্গে রয়েছি, এটা নিশ্চয়ই একটা এক্সপিরিয়েন্স। দেখি কত দূর বিচ্ছিরি দেখতে হতে পারে।
কল্পনা করতাম, আমার গোটা শরীরটাই যদি এ রকম দেখতে হয়ে যায়, কেমন হবে। সেটা ভেবে আরও গা শিউরে উঠত। কিন্তু এই শিউরানির একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। আমার চিন্তা ছেড়ে কিছুতেই বেরোত না। বরং ডিটেলে ভাবতাম, মুখে যদি এ রকম হয়, গাল দুটো যদি আরও চাপ, জমাট বাঁধা ফোসকায় ভরে যায়, গলায় যদি একটা মৌমাছির চাকের মতো ফোসকার চাপড়া হয়? সেই ভাবনাটা যেন ঘেন্নাটাকে আরও উসকে দিত।
অবশ্য বীভৎসতার এখানেই ইতি নয়। এর পর শুকোতে আরম্ভ করল ফোসকাগুলো। কিছুটা কিছুটা করে চামড়া উঠে যায় এক একটা জায়গা থেকে আর ঠিক ভুট্টা খাওয়ার পর যেমন ভুট্টার চেহারা হয় আমার হাতের চেহারাটা ও রকম হতে থাকে। খসখসে, চামড়া ওঠা চামড়া ওঠা। সেটার ঘেন্না আবার আর এক রকম।
কিন্তু কী আশ্চর্য, অন্যের এমন দেখলে তো কই আমার খারাপ লাগে না বা ঘেন্না করে না! আমি তো কত জনের কত ফোড়ায় কমপ্রেস করেছি, কত ঘা-এ মলম লাগিয়েছি। কত পুঁজ অনায়াসে সাফ করেছি। তখন কষ্ট হয়, মনে হয় সেই লোকটা কত দিনে সেরে উঠবে। আর নিজের বেলায় কেন এ রকম তীব্র ঘেন্না? আমি কি তবে মেনে নিতে পারিনি যে আমার শরীরও অন্য আর পাঁচ জনের মতোই এবং এমন বিকৃত রূপ ধরতেই পারে? নিজের সঙ্গে সঙ্গে এই হাতটা ঘুরবে, যে এমন কুশ্রী, এটা আমার কাছে অবাস্তব, হরর স্টোরি মনে হয়েছিল? আবার এটা যে আমারই, একদম আপন অঙ্গ সেটা আমাকে এর প্রতি এক রকমের অসম্ভব আকর্ষণে ঠেলে দিয়েছিল? এই সব মিলিয়েই তৈরি হয়েছিল সেই ভূত যার থেকে চোখ ফেরানো যায় না? |
|
|
|
|
|