|
|
|
|
|
|
শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান |
আজকের হিরো: পোস্ট পর্ন মডার্নিস্ট ম্যানিফেস্টো |
গৌতম চক্রবর্তী |
বাংলায় দেবীপক্ষের এই রবিবারে ‘পোস্ট পর্ন মডার্নিস্ট ম্যানিফেস্টো’ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই হাইকোর্টকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। কলকাতা পুলিশের ‘যানজট হবে, ভিড় বাড়বে’ গোছের আবেদন নাকচ করে যে ভাবে তাঁরা সোনাগাছিতে দুর্বার মহিলা সমিতির দুর্গাপুজোয় অনুমতি দিয়েছেন, তাতে অকুণ্ঠ সাধুবাদই তাঁদের প্রাপ্য। ভিড় হবে বলে নিউ ইয়র্ক পুলিশ পর্নো ছবির নায়িকা অ্যানি স্প্রিঙ্কল, ক্যান্ডিডা রয়্যাল বা ভেরোনিকা ভেরা-দের বড়দিনে গির্জায় ঢুকতে বাধা দিচ্ছে, এমনটা ঘটেনি। উলটে গত শতাব্দীতেই ওই তিন স্ট্রিপারকন্যা যৌনতার মুক্তি নিয়ে ম্যানিফেস্টো লিখেছেন। কবি, সুরকার ও নাট্যনির্দেশক ফ্রাঙ্ক মুর সেখানে সহলেখক হিসেবে সই করেছেন। যে দেশে ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ থাকার জন্য বারাঙ্গনাদের যৌনকর্মী বলা হয়, আর ভিতরে ভিতরে তাঁদের মাতৃপুজোর অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলে, তাকে আর যাই হোক, সভ্য বলা চলে না।
১৯৮৯ সালে অ্যানি, ক্যান্ডিডা এবং ভেরোনিকাদের এই ম্যানিফেস্টোয় মাত্র সাতটি ছোট ছোট নির্দেশিকা। প্রথমেই জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ‘সেক্স ইজ আ পজিটিভ থিং। সেক্সিনেস অট টু বি এমব্রেস্ড ইন আর্ট। লেট আস বি সেক্স-পজিটিভ।’ নিছক রিপুতাড়িত যৌনতা বা রিরংসা নয়, সেক্সিনেস-কে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে হবে। সেখানেই সৌন্দর্যচেতনা। একুশ শতকের ভারত যে এই জীবনমুখী চেতনাকে আজও গ্রহণ করতে পারে না, তার অন্যতম প্রমাণ মাস কয়েক আগে জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারম্যান মমতা শর্মার প্রতি রাজনীতিকদের চিৎকার। জয়পুরে এক অনুষ্ঠানে মমতা মেয়েদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘কেউ সেক্সি বলে টিজ করলে মনে মনে আর আহত হয়ো না। সেক্সি শব্দটা পজিটিভ!’ কিন্তু শব্দের পূর্ণতা-অপূর্ণতা, সেক্স এবং সেক্সিনেস-এর তফাত নিয়ে রাজনীতিকরা কবেই বা মাথা ঘামিয়েছেন! চলল যুক্তিহীন চিল-চিৎকার।
সেক্সিনেস কোথায়? অ্যানি স্প্রিঙ্কল-এর উপরের পোস্টারটিই তার প্রমাণ। পিন-আপ পোস্টার, পাশে পাশে হরেক মন্তব্য। যেমন, ‘করসেট: কোমরকে সাড়ে চার ইঞ্চি কমিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু শ্বাস নিতে পারছি না।’ ‘বুটজোড়া: দেড় ইঞ্চি ছোট, স্রেফ এই ফোটোশুটের জন্য ধার করা। হিলজোড়া বেশ উঁচু।’ তিরচিহ্ন দিয়ে দাগানো ‘ফল্স আইল্যাশেস’ ও ‘লাল লিপস্টিক’। মন্তব্যগুলিই যেন এই ক্ষীণকটি, স্তনভারে স্তোকনম্রা নারীশরীরের ছবিতে অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে দিল। এবং এতগুলি অসুবিধা উল্লেখ করার পরে নীচে তারাচিহ্ন দিয়ে লিখে দেওয়া হল, ‘এই সব সত্ত্বেও যৌন উত্তেজনা ভোগ করছি। ফিলিং গ্রেট!’ পর্নস্টার বা পিন-আপ গার্লের ছবির মাধ্যমে কৃত্রিম মেক-আপের কথা, এবং একই সঙ্গে মেয়েদের শরীরী কামনার স্বীকৃতি।
আর সেখানেই এই ম্যানিফেস্টো মিশে যায় আধুনিক নারীবাদী তত্ত্বের মোহনায়। নারীবাদ মানে তো শুধু সামাজিক লিঙ্গনির্মাণ এবং নারী-পুরুষ বৈষম্য হঠানো নয়। নারীর শরীরী ইচ্ছে-আনন্দ-উত্তেজনার অধিকারকেও স্বীকৃতি। পোস্ট পর্ন মডার্নিস্ট ম্যানিফেস্টো-র অন্যতম উল্লেখ্য দিকচিহ্ন কোথায়? সেই ’৮৯ সালে অ্যানি, ভেরা জানাচ্ছেন, ‘লিঙ্গ শুধুই সামাজিক নির্মাণ নয়, নারীর মানসচিহ্ন নয়, সে আমাদের শরীরের অংশ।’ আজ ‘ভ্যাজাইনা মোনোলগ্স’-এর মতো নাটক কিংবা নাওমি উল্ফ-এর নতুন বই ‘ভ্যাজাইনা: আ নিউ বায়োগ্রাফি’তেও মেনে নেওয়া হচ্ছে সেই তত্ত্ব। নাওমি তাঁর বইয়ে আফ্রিকার গৃহযুদ্ধে গণধর্ষণের শিকার মেয়েদের সাক্ষাৎকার নিয়ে, ডাক্তার এবং শারীরবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে জানাচ্ছেন, যোনির সঙ্গে মস্তিষ্কের কয়েক হাজার স্নায়ুর সরাসরি সংযোগ। যে কারণে শুধু শরীরী আঘাতের নিরিখেই ধর্ষিতার কষ্ট বোঝা যায় না। তার মনেও ভয়ংকর ছাপ পড়ে। হাত বা পা কাটা গেলেও মেয়েটির মনে সেই বীভৎস যন্ত্রণা জন্মায় না। পর্ন-তারকাদের লেখা ম্যানিফেস্টো আধুনিক নারীবাদের সঙ্গে কী ভাবে মিলেমিশে গিয়েছে, তার প্রমাণ এই সময়ের ডাকসাইটে ফরাসি পর্ন-নায়িকা ওভিদি-র কথা, ‘নারীবাদী তত্ত্বে আজকাল বিরক্তি লাগে। তাঁরা একটা-দুটো ছবি দেখেই পর্ন মানে এই-ওই বলে তত্ত্ব করতে বসেন। ওঁরা কেউ কেউ নিজেদের নৈরাজ্যবাদী ভাবেন ঠিকই, কিন্তু নিজেদের ইচ্ছা, কামনাকেও ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ থাকার মোহে বিসর্জন দেন। আমি বরং অ্যানি স্প্রিঙ্কল, ভেরোনিকা ভেরাদের বেশি সম্মান করি। পর্ন ছবি শুধুই পুরুষ দর্শকের জন্য পুরুষ পরিচালকের সৃষ্টি, এই বোকা বোকা ধারণায় তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। বরং যৌন আনন্দ উপভোগের নারীবাদ গড়ে উঠেছিল তাঁদের হাতেই।’
পর্ন-স্টার এবং যৌনকর্মী এক নন। কিন্তু টিভি শো-র অ্যাঙ্কর, সেক্স এডুকেটর, পর্ন ছবির নায়িকা ও প্রযোজক, পোস্ট পর্ন মডার্নিস্ট ম্যানিফেস্টোর অন্যতম রচয়িতা অ্যানি স্প্রিঙ্কল প্রায় ১৮ বছর যৌনকর্মীর কাজ করেছিলেন। এবং পোস্ট পর্ন নারীবাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে যৌনকর্মীদের মুক্তি। আশির দশকের শুরুতেও মার্কিন নারীবাদীদের একাংশ দাবি তুলেছিলেন, যৌনকর্মের কারণে মেয়েরা অপমানিত হন। তাই আইন করে ওই বৃত্তি নিষিদ্ধ করতে হবে। উত্তরে পোস্ট পর্ন মডার্নিস্টরা পালটা বললেন, নিষিদ্ধ করা চলবে না। যৌনকর্মী হওয়া মানে মেয়েদের অসম্মান হতে যাবে কোন দুঃখে? ওই পেশাটি সম্মান-অসম্মানের ওপর নির্ভর করে না। লিঙ্গবৈষম্য, দারিদ্র, ধর্মীয় বিভেদ, শ্রেণিবৈষম্য, মেয়ে পাচার, রাষ্ট্রের ভূমিকা অনেক কিছু খতিয়ে দেখতে হবে। বরং এইচআইভি-ধ্বস্ত এই পৃথিবীতে যৌনকর্মীদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বার্ধক্যে পেনশন ইত্যাদি জরুরি। পরবর্তী কালে দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশ যে যৌনকর্মীদের নিষিদ্ধ করার দিকে গেল না, বরং যৌনকর্মীদের অধিকার হয়ে গেল মানবাধিকারের অংশ, তার বীজ ছিল আশির দশকের ওই তর্কেই।
গত প্রজন্মের নারীবাদ পর্ন ছবি নিয়েও খড়্গহস্ত হয়েছিল। তাঁদের বক্তব্য ছিল, পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্যই পর্ন ছবিতে যৌনতা নিয়ে সেডিস্ট দৃশ্যের সমাহার ঘটে। আসলে মেয়েটি সেই সব দৃশ্যকল্পে ধর্ষণ ও পৌরুষী আগ্রাসনের শিকার হয়। পর্ন সিনেমা সেই বীভৎসতাকে ফ্যান্টাসির মোড়কে ঢেকেঢুকে রাখে। পোস্ট পর্ন ম্যানিফেস্টোর সময় আর এক দল নারীবাদী প্রকাশ্যে বললেন, কে বলেছে, পর্ন শুধু পুরুষের জন্য? পুরুষের শেখানো পরিবারপ্রথা থেকে বিচ্যুত হলেই তাকে বিপজ্জনক ভাবতে হবে? বরং নারীবাদ যে ভাবে মেয়েদের যৌনমুক্তির কথা বলছে, তাতে পুরুষেরই সুবিধা। নারী-স্বাধীনতার ব্যবহারিক আন্দোলন কখনও একটি মাত্র ইস্যুতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, সব পর্ন ছবিকে একই নিরিখে বিচার করতে পারে না। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গেল রুবিন, কানাডার ওয়েন্ডি ম্যাকএলরয় প্রমুখ নারীবাদী তাত্ত্বিকরা আজকাল ‘সেক্স পজিটিভ ফেমিনিজ্ম’ বলে একটি শব্দবন্ধও তৈরি করেছেন, নিজেদের বক্তব্যকে সেই নামে অভিহিতও করছেন।
পর্নস্টার ও একদা যৌনকর্মী অ্যানি স্প্রিঙ্কলের লেখা ম্যানিফেস্টোর সেই বাক্য এই ভাবেই আজ তাত্ত্বিক বিশ্ব থেকে সামাজিক আন্দোলনের রাজপথ সর্বত্র নিঃশব্দে ছড়িয়ে গিয়েছে। লেট আস বি সেক্স পজিটিভ!
|
|
|
|
|
|