|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন
|
ঠিক দু’দিন আগে সকালের এই মুহূর্তে হয়তো কারও কারও মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আকাশবাণী কলকাতার একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের কিছু সুর, ছন্দ, উচ্চারণ। মহিষাসুরমর্দিনী। ছেলেবেলা থেকে আমি অন্তত ওই নাম বলিনি, কোনও সাধারণ মানুষকেও বলতে শুনিনি। বলতাম ‘মহালয়া’। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র ইতিহাস নিয়ে কিছু বলতে চাইছি না। সংগীতের গোলাম আর শ্রোতা হিসেবে দু’চার কথা। ওই অনুষ্ঠান সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দু’এক জন বাঙালি শিল্পী, যাঁদের গান ওই অনুষ্ঠানের সম্প্রচারে এখনও শোনা যায়, সমকালে এমন একটা ভাব দেখিয়ে ফেলেছেন যেন লাইভ ব্রডকাস্টের যুগে তাঁদের গঙ্গাস্নান করে, হাত জোড় করে, ধূপ-ধুনোর গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে গান গাইতে হত। অতিরঞ্জন, সত্য গোপন মায় নির্জলা মিথ্যে কথা না বলে আমরা অতীত নিয়ে সচরাচর কিছু বলতে পারি না।
শরৎকালের ভোর চারটে। স্নান করে স্টুডিয়োয় যেতে গেলে সেই স্নান করতে হবে অন্তত রাত তিনটে-সাড়ে তিনটেয়। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র আদি যুগে, মায় গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেও, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর দাপট যখন অনেক কম ছিল, বাংলার শরৎরজনীর ওই প্রহরে গঙ্গায় অথবা আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের বাথরুমে ধর্মীয় শুচিবায়ুগ্রস্ত রীতিতে মাথা ভিজিয়ে, অঙ্গপ্রক্ষালনপূর্বক স্নান করে স্টুডিয়োয় গেলে, যখন-তখন হাঁচি আসতেই পারত। পেশাদার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে অমন ঝুঁকি অতি ধর্মপ্রাণ মানুষও নেবেন না। লাইভ সম্প্রচার। অর্থাৎ শিল্পী হঠাৎ হেঁচে ফেললে (চাপতে গেলে আরও বিপদ) ফের গোড়ার থেকে রেকর্ডিং করা হবে সে উপায় নেই। ফলে, ‘জাগো, তুমি জাগো/ জাগো হ্যাঁচ্চো...’। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী। |
‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সংগীত পরিচালক আচার্য পঙ্কজ কুমার মল্লিক ছিলেন আধুনিক মানুষ। গলা নিয়ে গায়ক-গায়িকাদের খুঁতখুঁতানির অন্ত থাকে না এমনিতেই। আগেকার দিনে আরও বেশি ছিল। নিজে গায়ক হয়ে তিনি অন্য কণ্ঠশিল্পীদের শরৎকালের ভোর রাতে স্নান করে ঠান্ডা লাগানোর ঝুঁকির সামনে ফেলে দিতেন ভাবতেও কেমন লাগে। অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ‘রূপং দেহি’-তে যিনি তাঁর একক অংশে কণ্ঠটি মহাকাব্যিক গরিমায় তারসপ্তকের এক অশ্রুতপূর্ব স্তরে তুলে নিয়ে গিয়ে সচেতন ভাবে আজানের স্বরপ্রক্ষেপ প্রয়োগ করেন, তিনি আর যা-ই করুন, ধর্মীয় গোঁড়ামির আশ্রয় নেবেন না।
১৯৭১ সালে, সরস্বতী পুজো উপলক্ষে প্রযোজনা করা আকাশবাণীর এক বিশেষ সংগীত-আলেখ্যে কয়েক জন কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে আমিও স্থান পেয়েছিলাম। সংগীত পরিচালক ছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। সরস্বতী পুজোও তো ধর্মীয় ব্যাপার। কিন্তু অনুষ্ঠানটি ছিল সেকিউলার। কই, সংগীত পরিচালক তো রেকর্ডিং-এর আগে আমাদের স্নান করে আসতে বা সকাল থেকে না খেয়ে থাকতে বলেননি! ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সংগীতের মহাকাব্য। জীবন ও ঘটনার উপাদানের প্রাচুর্য ও বৈচিত্রের দিক দিয়ে মহাভারত যেমন, সংগীত উপাদানের বৈচিত্রের দিক দিয়ে তেমনিই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। অবাক লাগে যে জাতি (বাঙালি) এমন সংগীত-মহাকাব্য সৃষ্টি করতে পারে সেই জাতি এই মহাসৃষ্টি চর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি শিক্ষাক্রম তৈরি করতে পারল না! প্রত্যেক বছর আকাশবাণী কলকাতার এডিটর সুধীর মুখোপাধ্যায় অন্তত বছর দশেকের নানান রেকর্ডিং থেকে কোনও না কোনও রেকর্ডিং বেছে নিয়ে একটি পৃথক সংকলন তৈরি করতেন। আমরা আজ সমানে শুনে চলেছি সেগুলিরই একটি। বাকি রেকর্ডিংগুলো কোথায় গেল কেউ জানেন? ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রথম গান বা স্তোত্রটি মালকোষ রাগে, দশ মাত্রায়। মালকোষ রাতের রাগ। কোমল গা, শুদ্ধ মা, কোমল ধা ও কোমল নি পাঁচটি স্বরের এই রাগে মেলে শান্ত গরিমা ও প্রচ্ছন্ন আনন্দের মেজাজ। মালকোষ রাগে কোনও দুঃখের গান সচরাচর শোনা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানটি শুনলে আমরা এই রাগের বৈশিষ্ট্যের স্বাদ কিছুটা পাই। দু’এক জন জ্ঞানী মানুষের কাছে শুনেছি রবীন্দ্রনাথ নাকি ওই গানে একটি অমালকোষী স্বর লাগিয়েছিলেন। তা হবে। কিন্তু কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রামোফোন রেকর্ডে তো মোটের ওপর মালকোষের লক্ষণই পাওয়া যায়।
মালকোষের পাঁচটি স্বর এমন যে খরজ পালটালে, অর্থাৎ মন্দ্রসপ্তকের কোমল ধা-কে বা মধ্যসপ্তকের কোমল গা-কে ‘সা’ মানলে বিভিন্ন রাগের রূপ ফুটে ওঠে। রাত থাকতে শুরু হওয়া ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রথম গানের জন্য এই রাগই উপযুক্ত, কারণ মহাকাব্যিক গরিমা কানাড়া অঙ্গের রাগগুলিতেও পাওয়া যায়, কিন্তু মালকোষের প্রচ্ছন্ন আনন্দ সেখানে এই মাত্রায় নেই।
প্রথম গানের সুরের রেশ ধরেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তাঁর পাঠ শুরু করছেন। তিনিও মালকোষের স্বরগুলিতেই থাকছেন। প্রথমে মধ্যসপ্তক। নেপথ্যে তানপুরা, ভাইব্রাফোন ও সম্ভবত স্বরমণ্ডল মালকোষের স্বরপরিমণ্ডল রচনা করে দিচ্ছে। এই অনুষ্ঠানে যন্ত্রের প্রয়োগ লক্ষণীয়। অনেক যন্ত্র, কিন্তু স্থির, অনুচ্চ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ক্রমশ তারসপ্তকের সা আর মধ্যসপ্তকের কোমল নি ও কোমল ধা এই তিনটি স্বরকে প্রাধান্য দেবেন। এই পরিমিতির মাধ্যমে তিনি এক দিকে বজায় রাখতে পারবেন রাগটির মেজাজ আর অন্য দিকে তাঁর পাঠের ঋজুতা। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র পাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বিবরণ দানের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন সৃষ্টি করেছিলেন। বছরের পর বছর এই অনুষ্ঠানটি শুনে শুনে আমরা এমনই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে খুঁটিনাটি দিকগুলি বা এই অনুষ্ঠানের অভিনব বৈশিষ্ট্যগুলি আমরা আর আলাদা করে খেয়াল করি না। প্রথমত, স্বরগুলি তিনি লাগিয়েছেন মিড় দিয়ে বা ভক্তিগদগদ চিত্তে হেলেদুলে-ইনিয়েবিনিয়ে নয়, সরাসরি, খাড়া। দ্বিতীয়ত, বেশি স্বর তিনি ব্যবহার করেননি। স্বরের এই পরিমিত ব্যবহার অনুষ্ঠানের গানগুলির স্বরবৈচিত্রের পাশে তাঁর পাঠকে একটা মেদহীন ঋজুতা ও পৃথক চরিত্র দিয়েছে। সম্পূর্ণ সুরে ও ছন্দে থেকেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ কখনও গান গেয়ে ওঠার উপক্রম করেননি। তাঁর উক্তি, গদ্য-বিবরণ গানও নয়, গানের মতোও নয়। সেগুলি উক্তিই। শুধু সুরে অবস্থিত থেকে তিনি অনুষ্ঠানটির সংগীতাবহের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে গিয়েছেন। পাশ্চাত্যে কোনও কোনও গির্জার প্রার্থনা অনুষ্ঠানে শুনেছি যাজক তাঁর বাণী দিচ্ছেন সমবেত কণ্ঠে গাওয়া উপাসনাগীতির সুরের রেশ ধরে, ভক্তি-আপ্লুত হয়ে, প্রায় গান গেয়ে গেয়ে। কিন্তু এই অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আঙ্গিক একেবারেই আলাদা। বেতার সম্প্রচারের ইতিহাসে তাঁর পাঠ একটি আলাদা অধ্যায়। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র দ্বিতীয় গানটি ভৈরবী রাগে। প্রথম গানের মালকোষে কোমল রে ও পা যোগ করে দিলে ভৈরবীকে পাওয়া যায়। ভোর এসে পড়ছে। আর রাতের রাগ মালকোষে থাকা যায় না। দুটি মাত্র স্বর জুড়ে দিয়ে ভৈরবী। শুরু হল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সুর পরিক্রমা। লক্ষণীয়: দ্বিতীয় গানটি ভৈরবী রাগে হয়েও সম্পূর্ণ স্বরসংগতিতে পরিবেশিত harmonised. রাগরূপ সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ রেখে কী ভাবে ত্রিস্তর-স্বরসংগতি তৈরি করে নেওয়া যায় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ তার স্মরণীয় উদাহরণ। মনে রাখা দরকার বেতারে পরিবেশিত বাংলা গানে সলিল চৌধুরীর আগেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে স্বরসংগতি প্রয়োগ করা হয়েছিল।
আকাশবাণীর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র মতো অনুষ্ঠান নিয়েও আমাদের দেশের সংগীত আলোচকরা, শিল্পীরা বিশ্লেষণমূলক কিছু লিখেছেন বা বলেছেন বলে জানা নেই। বিপুল দেনা আমি একা শোধ করতে পারব না। আমার এই চেষ্টা প্রয়োজন অনুপাতে কিছুই না। তা-ও চেষ্টা।
এ চেষ্টা আগামী পর্বেও চলবে। |
|
|
|
|
|