রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
পুজো বন্ধ হোক
কেমন লাগত, মুদির দোকানে গিয়ে যদি দেখতেন, দশহাতওলা মহিলা পাঁউরুটি কিনছে, পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে গেল যে তার ধড়টা মানুষের মাথাটা হাতির, আর রাস্তায় শুয়ে থাকা মোষটার ভুঁড়ি ফাটিয়ে বেরচ্ছে একটা মুশকো জোয়ান! কচি কচি বাচ্চাগুলোর প্যান্ডেলভর্তি হরর-মনস্টার দেখে চড়াৎ শক লাগে। কপালে দগদগ চোখ দেখে চুয়িং গাম পেটে সেঁধিয়ে যায়। বলে না, জানে মা-বাপ ডাব্ল স্ট্যান্ডার্ডের পাবলিক, কার্টুন নেটওয়ার্কে দেখে চিল্লাবে ‘ইইক্, বীভৎস প্রাণী! স্টপ!’ আর প্যান্ডেলে জনে জনে নমো করাবে।

সব চ্যানেলে এই সিজনে হয় সিরিয়াল বন্ধ করে অন্য প্রোগ্রাম দেখায়, নয় সিরিয়ালে গায়ের জোরে পুজোর সিন ঢুকিয়ে দেয়। আরও সাংঘাতিক, গোঁজামিল ফ্ল্যাশব্যাকের বান ডাকে। কোনও চরিত্র হাঁ করে অতীত ভাবছে দেখিয়ে, আগের সব এপিসোড থেকে খাপচা খাপচা নিয়ে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট করে চালিয়ে দেয়। লয়্যাল দর্শকদের প্রতি কী বঞ্চনা!

অফিস থেকে ফিরে দেখেন সদর দরজা জুড়ে প্যান্ডেল, নিজের বাড়িতেই নিজে ঢুকতে পারছেন না। গাড়ি তো ভুলভুলাইয়ায় দণ্ডিত, যেখানে সেখানে ‘নো এন্ট্রি’ আবির্ভূত ভিডিয়ো গেমের ত্রিগুণ স্পিডে। চিরচেনা রুটের রিকশা-অটোওয়ালা দেঁতো হাসি হেসে জানাবে পুজোর দশ দিন আগে থেকে ভাড়া তিন টাকা বেশি, কালীপুজো পেরোলেও সে ভাড়া কমবে না। রোগী নিয়ে কোন রুটে হাসপাতালে পৌঁছবেন ভাবতে ভাবতেই সে ফৌত, আর পৌঁছতে পারলে নার্সের খ্যাঁকানি, ‘সেরিব্রালের আর দিন পেলেন না!’ সব্বাই মস্তি করছে বলে আপনার স্বাভাবিক জীবনের অধিকার থেঁতলে পিন্ডি, এবং সে নির্লজ্জ আনন্দ-মস্তানির সামনে আপনি কেঁচো হয়ে নিজমনে মিনমিন।

পথের পশুগুলো কেঁদে খুন! গাছে লাইট ও মাইক ওদের চোখের ঘুম কানের শান্তি কাড়ছে, রাস্তায় পেরেক বাঁশ ও সুন্দরীদের হাই-হিল ক্ষণে ক্ষণে খুঁচিয়ে দিচ্ছে, ইয়াব্বড় প্যান্ডেলে খানা খজানার খোশবাইয়ে নাল এসে যাচ্ছে, কিন্তু ঢুকতে গেলেই ডান্ডা-পেটা। প্যান্ডেলের মধ্যে অতগুলো বিশাল পশুপাখি নট নড়নচড়ন কেন গ্যাঁট হয়ে আছে, ওরা কি মরে গেছে, গেলে কে মারল, তা হলে কি ওদেরও বিপদের সম্ভাবনা: কেউ ব্যাখ্যা করছে না। এই কনফিউশনের মধ্যে ভাসানের তুমুল নেত্য। তিনতলা স্নিকারের চাপে ল্যাজের আর কিছু থাকে!
যাদের প্রেম নেই, সিংগল, তাদের কাছে পুজো সেঁকো বিষ। দিবারাত্র মাইকে হাস্কি হাস্কি গলায় মেটিং কল ছড়িয়ে পড়ছে, কাটা ঘায়ে আচ্ছাসে বিটনুন অ্যাপ্লাই, আর সামনে দিয়ে হাত-ধরাধরি পালে পালে ঝক্কাস হ্যাপি যুগল। আর যারা সিংগল নয়? কমিটেড? আরও করুণ বেহালা। দাঁত বার করে সুখ দেখাতে হচ্ছে, কিন্তু চতুর্থী থেকে দশমী একই লোকের হাত ধরে দুনিয়া ঘুরতে অখাদ্য লাগছে। অদূরেই জিম করা হাংক ও সুবেশা তন্বী, অথচ প্রোপোজ দূর অস্ত। মরালিটিতে বাধবে! বিবাহিতের কথা তো ছাড়ান দিন। খাঁচার জীবের আবার প্রেম, পুজো, বা পুজোর প্রেম, কোনটা বেঁচে আছে?

লাল সালুর দোকানে আগে সব বসে থাকত মাথার জ্যোতিফোতি সামলে, দুগ্গার সমান লেনিনবাজি, মনে হত বই নয়, অনুগ্রহ বেচছে, একখান কিনলে বিপ্লবের বাতাসা ফ্রি। আর এখন? খাঁ-খাঁ বললে খাঁ-দের অপমান করা হয়। ভিকিরি অবধি ভুলেও দাঁড়াচ্ছে না। চাট্টি সেকেন্ড-হ্যান্ড জ্যালজ্যালে বই পতপত, মলাটে ছ’জম্মের ধুলো। বাচ্চাদের দুরন্ত বই সব হাপিস, পাবলিকেশন নাকি উঠে গেছে। শুধু টিমটিম করছে বিষণ্ণ ঝাপসা দাড়িওলা মুখ, উহা মার্ক্স না ছোটপিসে? পুজো বন্ধ হলে অ্যাট লিস্ট এই মেগা-ট্র্যাজেডি চোখে পড়বে না: চির-পুজো কাহারও সমান নাহি যায়।

বাসে বা মেট্রোয় ঠাকুর দেখতে বেরোলে, মরেছেন। মেট্রোয় হলে ভিড়ের চাপে। বাসে হলে স্রেফ হাই তুলে তুলে চোয়াল লক হয়ে, কারণ সে নট নড়ন চড়ন ঘণ্টা দেড়েক। যদি গাড়ি থাকে? প্রথমটা আপনি আত্মহারা। পায়ে-হাঁটারা ব্যাকটেরিয়া। ওরা ঘেমো, আপনি এসি। তবে, কিছু পরেই: আপনি এক মিলিমিটারও এগোননি। পাশের ভিড় বনেটে গা এলিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে। ঠাকুর দেখে বেরিয়ে মাইকের গান পেরিয়ে রামচিল্লানি: ‘পার্কিং কোতায় করেচোওও?’ ড্রাইভারের মোবাইলে চার্জ নেই। গাড়ি খুঁজতে আড়াই ঘণ্টা, গোড়ালির নলি খুলে হাঁটা সতেরো মাইল (গাড়ি না-থাকাদের চেয়ে সাড়ে ছ’গুণ!)

বাপের বাড়ি থেকে পুজোর তত্ত্ব এসেছে। সুতরাং বাড়ির বউ হিসেবে আমিই অভ্যর্থনার দায়িত্বে। আগের দিন বেছে বেছে বাজার করি, পরের দিন সারা সকাল রাঁধি, ওরা এলে চা বানাই, সঙ্গে হালকা স্ন্যাক্স, জামাকাপড় মিষ্টি দই গুছিয়ে তুলি, উৎকট বোরিং আলোচনায় হাই চেপে হাসিমুখে বসে থাকি, রাতে যত্ন করে পরিবেশন করি, খাবে না জেনেও ভর্তি হাতা হাতে ‘একটু দিই, একটু দিই’ আউড়ে বনবন টেবিলের ধারে ঘুরি, ওরা চলে গেলে সবার হাতে তত্ত্ব তুলে দিই। সামনের রবিবার আমার ঠিকানা হবে বাপের বাড়ি। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আসবে তত্ত্ব হাতে। বাড়ির মেয়ে হয়ে আমি বেছে বেছে বাজার করব, সারা সকাল রাঁধব, চা বানাব, সঙ্গে হালকা স্ন্যাক্স...

মহালয়ার দিন রাত বারোটা থেকে টানা দিন পনেরো ইনবক্সে গোঁতাগুঁতি করবে ন্যাকা যাচ্ছেতাই এসএমএস, প্রত্যেকটায় ছন্দের ভুল। ‘ষষ্ঠীতে আনন্দে তালি, অষ্টমীতে অঞ্জলি, দশমীতে জলাঞ্জলি, তার পর কোলাকুলি’ দেখলেই মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ছড়ার অসুখ সংক্রামক এবং পুজোর সময় জয়বাংলার চেয়ে বেশি ছড়ায়। হোর্ডিং, ব্যানার সর্বত্র পুজো অ্যানাউন্স করতে গেলে মিল দিতেই হবে, কে আইন করল! ওপরে কাশফুলের ছবির তলায় শরতের কাশ, তলার লাইনে সামনে বাঁশ, সবচেয়ে নীচে মাইক্রো হরফে সাবধানে আসবেন!

যারা বেড়াতে গেছে, প্রকাণ্ড পারফরমেন্স অ্যাংজাইটি! ক্রমাগত নিজেকে বোঝাতে হচ্ছে, পুজোয় কলকাতায় না থেকে বেটার ডিসিশন নিয়েছি। সুতরাং, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে যারা নেচে বেড়াচ্ছে তাদের ছ’গোল দিতে হবে! তাই রিল্যাক্স-চিল্যাক্সকে শিকেয় তুলে ভাগ মিলখা ভাগ। ভোর তিনটেয় ফ্লাইট, নেমেই বোঁ বোঁ করে পাহাড়ে, বেলা পড়ার আগে সমুদ্রে ঝপাং, বিকেলে আকবরের মেসোমশাইয়ের সমাধিতে টিক। সন্ধেয় চোখ ঢুলে এলেও কফি খেয়ে ঘুম তাড়িয়ে আদিবাসী মেয়ের ধিতাং ধিতাং দেখো। বেড়াতে এসেছে না পরীক্ষার জন্য খাটছে কমপ্লিটলি গুলিয়ে যাচ্ছে। হাতে কালি চোখে কালি, বাছা আমার ঘুরে এলি?

এথিক্স-এর দিক থেকে তো সাংঘাতিক ভুল। একটা লোককে কিলিয়ে কাঁটাল পাকিয়ে সমস্যার সমাধান করা যায়: ঢাক পিটিয়ে প্রচারযোগ্য থিয়োরি? বোঝানো-সোঝানো নয়, আলোচনায় বসা নয়, দীর্ঘমেয়াদি সচেতনতা-জাঠা-প্রকল্প ভাঁজা নয়, অশুভ-র ঘাড়ে দাবড়ে ঠ্যাং রেখে, ত্রিশূল খুঁচিয়ে, সিংহ লেলিয়ে, সাপ ছুবলিয়ে, নির্মম ভাবে ফালাফালা করে তবে শুভকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে: ভায়োলেন্সকে প্রচণ্ড তোল্লাই দেওয়া এই শিক্ষায় দু’হাত তুলে নাচা পাবলিক যে চোরকে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে সমান ইউফোরিয়ায় ধোলাই দেবে, আর নিজ সততার গ্লোরি পোয়াবে, আশ্চর্য কী?

আপনি লেখক? কথাই নেই। পুজো আসার ন’মাস আগে থেকে টাটিয়ে শুরু প্রসব-যন্ত্রণা। আপনিই লিখবেন বড় পত্রিকায় উপন্যাস, মেজোতে ছোটগল্প, সেজোয় প্রবন্ধ, ন-তে দীর্ঘ কবিতা। না লিখে যাবেন কোথা, আগের পুজোর একাদশীতেই অগ্রিম চেক-নগদা নিয়েছেন, এন্তার প্রমিস বিলিয়েছেন, এখন চিড়বিড়োলে হবে? দুনিয়া ক্ষয়ে-বয়ে যাক, কোঁত পেড়ে ‘নামাতে হবে’ সাহিত্য-বুঁচকি। তাতেও রক্ষে নেই। নবমীর দিন প্যান্ডেলের বাঁ-ধারে আলতো ফিশ ফ্রাই মুখে ফেলছেন, গদগদ ভক্ত এসে: ‘দাদা এ বার রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত চিঠিগুলো যা লিকেচেন, উফ্ফ্!’

পাড়ার গলতার মোস্ট খাজা প্যান্ডেলেও খানদশেক ট্রফি: শ্রেষ্ঠ অসুর, শ্রেষ্ঠ ইঁদুর, শ্রেষ্ঠ ঝাড়লণ্ঠন, শ্রেষ্ঠ হাতের লেখায় ‘জেন্টস’ ও ‘লেডিস’! যত পুজো, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাইজদাতা। বাজারে নিজ সংস্থার নাম ফাটাতে হামলে পড়ে সক্কলে পাইকারি রেটে প্রাইজ বিলোনোয় যা হল: পুরস্কার থেকে সম্মানটুকু টুক করে খসে পড়ে গেল। এর পর হয়তো কম্পিটিশনে ঠেলে উঠতে: শ্রেষ্ঠ খারাপ-দেখতে প্রতিমা, শ্রেষ্ঠ প্যান্ডেল-ইভ-টিজিং!

আঃ আটকাসনি, এমন জুতোর সুখতলার মতো মোগলাই পরোটা আর পাব গোটা বছরে? উফ, বুড়ির মাথার পাকা চুল মানে তো হাতে আস্ত শৈশব। তার পর ফুচকা। না খেলে ঠাকুর পাপ দেয়। আর লাল রঙের কী একটা ঝোল দেওয়া ঝালমুড়ি। এ ছাড়া পাড়ার পুজোর কাত্তিক ঠাকুরের ডান বগলের তলা দিয়ে ফিউশন ফুডের স্টলে চিকেন রেশমি ছ’পিস আশি টাকায় দিচ্ছে, না খেলে ওরা কষ্ট পাবে। এমন সময় হারেরেরে, ওই তো কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে। পেট পেট পেট, তোর জন্য মাথা হেঁট হেঁট হেঁট। কে আছো, বেরোও, খোলো বাথরুমো গেট গেট গেট।

প্রতি পলে নিজেকে কেন্নো মনে হয়। কেন আমি এত কম সাজলাম? কেন গ্রিন কাজল পরলাম না! ওই তো এই মেয়েটা পরেছে। ইস্স্, গ্লিটারটা লাগালে কী-ই বা ক্ষতি ছিল? উফ, ওর কী ফিগার! জিম জয়েন করলাম, পয়সা দিলাম, তবু জাস্ট ঘুুমিয়ে অ্যাবসেন্ট! হীনম্মন্যতা আরও গাঢ়, যখন নিজের পাড়ার পুজোয় ঢুকতে গিয়ে আখাম্বা ভলান্টিয়ারের হাঁক: ‘ভিআইপি পাস আছে?’ আমতা আমতা ও অভিমানী রিট্রিট। গুটিগুটি পরের প্যান্ডেলে উঁকি। সেখানেও ডিটো। পুজো এসে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়: আমি কী ইনফিরিয়র!

অমানুষিক খাটনি। মাস তিন। অগস্ট আসা মাত্র, অফিস থেকে এক দিনও বাড়ি গিয়ে গড়াতে দেবে না। মারো ঘন্চক্কর। হকারদের সঙ্গে ঝগড়া পাকাও, আর শপিং মলগুলো তো ছোটামোটা শহর, একটা ফ্লোর কভার করতেই হাড়-মড়মড়ি ব্যারাম। ক্রমে পিঠে দমাদ্দম: ভোর পাঁচটায় পার্লারে লাইনে, অফিসে ঊর্ধ্বশ্বাসে কাজ খতম, রাত আটটায় আত্মীয়ের বাড়ি জামাকাপড়ের মোট বয়ে নিয়ে যাওয়া। শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে বিছানায় ঝাঁপাতে গিয়েই উই মা! কাল মহালয়া! অ্যালার্ম। আর পঞ্চমী এসে গেলে! রোজ চার ঘণ্টা ধরে সাজো, দুনিয়ার ঠাকুর দ্যাখো ও মোবাইলে তোলো ও ফরোয়ার্ড করো, হোলনাইট-এর পর দিনই ফের সকাল এগারোটা থেকে বাঁইবাঁই। ওরে বাপ আমার, কোমর জিরোতে দে, পুজো বন্ধ কর। তার বদলে দে খানতিন সিম্পল ঢুলুঢুলু রোববার।

কাগজের ফিচার দফতরের তলপেট গুড়গুড়: আবার পুজো নিয়ে বানাও আশ্চর্য নতুন ঘ্যাঁট! সাপ্লিমেন্ট রে, কভার স্টোরি রে, লটকে লট পুজো স্পেশাল। একটা উৎসব বেঁকিয়েচুরিয়ে বচ্ছর বচ্ছর কদ্দূর অ-ক্লিশে পয়দা করা যায়! ইদিকে নিন্দুক মুখিয়ে: ‘যঁথেষ্ট নিঁউ থিঁংকিং হঁয়নি।’ এত কাণ্ড কেন? না, পুজোর সকালে লোকে কাগজ পেতে লুচির ডিশ রাখবে।

ছবি: সুমন চৌধুরী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.