রুটিনে লেখা শারীরশিক্ষার ক্লাস। মাটিতে পাতা রয়েছে শতরঞ্চি। কিন্তু শিক্ষকের দেখা নেই। নির্ধারিত সময়ের প্রায় আধঘণ্টা পর স্কুলের শিক্ষক এলেন বটে, তবে তিনি শারীরশিক্ষার নন। অঙ্কের শিক্ষক। গম্ভীর মুখে বীজগণিতের ফর্মুলা মুখস্থ করতে দিলেন তিনি। শারীরশিক্ষা আর হ’ল না।
কমবেশি এই ছবি গ্রাম বাংলার প্রায় সব স্কুলেই। ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের একাংশের অভিযোগ, খেলাধুলায় গুরুত্ব দেয় না বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বছরে একবার স্কুল অ্যাথেলেটিক্স আর বড়জোর আন্তঃশ্রেণি ফুটবল, এই হল বিদ্যালয়গুলির ক্রীড়া-কর্মসূচি।
সম্প্রতি নড়েচড়ে বসেছে বিদ্যালয় শিক্ষা দফতর। সম্প্রতি বিদ্যালয় ক্রীড়া বিষয়ে একটি নির্দেশিকা জারি করেছে এই দফতর। সেখানে বলা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব জেলা ও মহকুমা স্তরে বিদ্যালয় ক্রীড়া কমিটিগুলিকে নতুন করে তৈরি করতে হবে। নজর দিতে হবে বিদ্যালয় স্তরে ক্রীড়া পরিকাঠামো তৈরির দিকে। এই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, জেলা স্তরের বিদ্যালয় ক্রীড়া কাউন্সিলের কমিটির সভাপতি থাকবেন জেলাশাসক। এই কাউন্সিলের সদর দফতর হবে জেলা সদরে। অপর দিকে মহকুমা বিদ্যালয় ক্রীড়া পর্ষদের সভাপতি হবেন সংশ্লিষ্ট মহকুমাশাসক। এর সদর দফতর থাকবে মহকুমা শহরে। বিদ্যালয় শিক্ষা দফতর সূত্রে খবর, দু’টি কমিটিরই মেয়াদ থাকবে ৩ বছর। ইতিমধ্যেই মধ্য কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া জেলায় কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। বিদ্যালয় শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বাকি জেলাতেও পুজোর পরেই ক্রীড়া কাউন্সিলের কমিটি তৈরির কাজ শেষ করে দেওয়া হবে। |
জেলার বেশির ভাগ স্কুলের মাঠেই আর খেলা হয় না।—ফাইল চিত্র।
|
রাজ্য বিদ্যালয় ক্রীড়া পর্ষদের যুগ্ম সম্পাদক দিলীপ যাদব বলেন, “নতুন কমিটিগুলির কাজ হবে, সরকারের নীতি এবং কর্মসূচি অনুযায়ী বিদ্যালয় স্তরে খেলা পরিচালনা করা। এই কমিটিগুলি বিদ্যালয়ের খেলার ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা নেবে। বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করবে।” তিনি আরও জানান, মহকুমা স্তরের বিদ্যালয় ক্রীড়া পর্ষদের দেখভালের দায়িত্বও থাকবে জেলার কমিটির উপর। কাজের ক্ষেত্র বাড়াবার জন্য মহকুমা ও জেলা বিদ্যালয় ক্রীড়া কমিটিগুলিকে নানা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। নতুন কমিটির যাবতীয় সমস্ত আর্থিক লেনদেন হবে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে।
তবে, নতুন ভাবে তৈরি হওয়া বিদ্যালয় ক্রীড়া কাউন্সিলগুলি বিদ্যালয় ক্রীড়াকে কতটা চাঙ্গা করতে পারবে সে বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
বিদ্যালয় ক্রীড়া শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, আগে জেলা স্কুল ক্রীড়া কমিটির সদস্যরা বেশির ভাগই ছিলেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক। কিন্তু বর্তমান কমিটিতে মনোনীত সদস্যই বেশি থাকবেন। থাকবে নিকটবর্তী এসআই অফিস-সহ সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিরাও।
মেদিনীপুর জেলা স্কুল ক্রীড়া সংস্থার বর্তমান সম্পাদক সোমনাথ দাস বলেন, “বিদ্যালয় ক্রীড়া দেখভালের কমিটি আগেও ছিল। এ বার কেবল জোনাল স্তরের কমিটিগুলিকে তুলে দেওয়া হয়েছে।” বিদ্যালয়গুলিতে শারীরশিক্ষাকে অবহেলা করা হয় বলে অভিযোগ করে তাঁর পরামর্শ, “কমিটিকে প্রতিটি স্কুলে নজর দিতে হবে।”
উত্তর ২৪ পরগনার ন’হাটা হাইস্কুলের ক্রীড়াশিক্ষক সুশান্ত মোদক বলেন, “প্রতিটি স্কুলে সব বিষয়েই চার থেকে পাঁচ জন শিক্ষক থাকেন। কিন্তু ক্রীড়া শিক্ষকের সংখ্যা একজন থেকে দু’জন। তাঁদের আবার অন্য বিষয়ের ক্লাস করতে হয়। এ ছাড়া মাঠ ও পরিকাঠামোর সমস্যা রয়েছে।” তাঁর পরামর্শ, প্রতিটি স্কুলেই নানা ক্রীড়া বিভাগে কিছু প্রতিভা থাকে। কিন্তু অনেকেই কোনও সুযোগই পায় না। তাই কোনও বিভাগের জেলা দল তৈরির সময় প্রতিটি স্কুল ধরে বাছাই করা উচিত।
হাওড়ার জগৎবল্লভপুরের চিন্তামণি হাইস্কুলের ক্রীড়াশিক্ষক বিশ্বনাথ ঘোষের আক্ষেপ, এই প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা খেলায় উৎসাহ হারিয়েছে। তাঁর কথায়, “বর্তমানে বিদ্যালয় স্তরের ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলিতে বয়স ভাঁড়িয়ে এবং অন্য স্কুলের ছাত্রদের খেলানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটা বন্ধ করা দরকার।”
বাংলার বেশির ভাগ ক্রীড়াবিদই উঠে এসেছেন স্কুল স্তর থেকে। কী বলছেন তাঁরা?
মহমেডান স্পোর্টিংয়ের খেলোয়াড় দীপেন্দু বিশ্বাস বলেন, “বসিরহাট স্কুলের মাঠে খেলে আমি বড় হয়েছি। এখন ওই মাঠে খেলা হতে দেখি না। শুধু বসিরহাট স্কুলই নয়, জেলার বেশির ভাগ স্কুলের মাঠেই খেলা হয় না।” তাঁর মতে, স্কুল স্তরে খেলাধুলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্রীড়া শিক্ষকদের শুধু খেলাধুলার দায়িত্বই দেওয়া উচিত। এশিয়াডে সোনাজয়ী প্রাক্তন অ্যাথেলিট জ্যোর্তিময়ী শিকদার অবশ্য নতুন কমিটির বিষয়ে আশাবাদী নন। তিনি বলেন, “স্কুল ক্রীড়ায় যে কমিটি করা হয়েছে সেখানে যদি রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সদস্য হয় তা’হলে কী লাভ? মাঠের লোককে দায়িত্ব দিতে হবে।”
আরোও অনেক দীপেন্দু, জ্যোতিপ্রিয় কী তৈরি করতে পারবে গ্রাম বাংলার বিদ্যালয়গুলির সবুজ মাঠ? উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। |