রাতের দিকে কানটা একটু খাড়া করে শুনবেন। ওরা বলছিল, ঝিঁঝিঁপোকার ডাক বাড়তে শুরু করলেই বোঝা যায়, পুজো আসছে! ওরা আরও বলছিল, শরতের একটা আলাদা গন্ধ থাকে। খানিকটা রোদ, খানিকটা শিশির, সঙ্গে কদম আর শিউলি ফুল মেশানো টাটকা সপ্রাণ একটা গন্ধ। হাওয়ায় যখন সেই গন্ধটা ভাসে, যখন সকালে ঘাসের উপর হাঁটতে গেলে পা দু’টো ভিজে-ভিজে যায়, তখন ওরা বুঝতে পারে, পুজো আসছে।
আমরা বলি, ‘পুজোর গন্ধ’। সেটা তো আক্ষরিক অর্থে গন্ধ নয়। শরতের আকাশ, রোদ, মেঘ, কেনাকাটা, ছুটি, পুজোর আলোচনার মিশেলে তৈরি একটা মানসিক অনুভূতি মাত্র। আসল গন্ধ ধরা পড়ে ওদের চেতনায়। শুধু চোখ দিয়েই দেখতে হবে, এমন নিয়ম নিশ্চয়ই আমাদের, সুবিধাপ্রাপ্ত সংখ্যাগুরু চক্ষুষ্মানদের তৈরি। আমরা জানিই না, দু’চোখে আজন্ম অন্ধকার নিয়েও এক অপার্থিব দুর্গাদর্শনের শরিক হওয়া যায়!
শরতের এক বিকেলে নরেন্দ্রপুরে দৃষ্টিহীন ছাত্রদের অ্যাকাডেমির হলঘরে পৌঁছেছিলাম। জনা কুড়ি ঝকঝকে কিশোর। ক্লাস সেভেন থেকে টুয়েলভ, জ্বলজ্বলে সব মুখ। দুর্গাপ্রতিমা সম্পর্কে ধারণা থাকার কথা নয় এদের। তবু মানসচোখে কি ধরা দেয় কোনও চেহারা? প্রশ্ন করি। এ দিক ও দিক থেকে মুখগুলো কথা বলতে শুরু করে।
ছোটবেলায় চেতনার কালো সরিয়ে কোনও কিছু কল্পনা করা সহজ ছিল না। এটা আসলে রপ্ত করতে হয়। তখন কত বার দুর্গাঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে ভেসে যাওয়া দু’চোখ হাতের তালুতে মুছতে হয়েছে। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, কোনও অনুমান করতে পারছি না। সবাই বলছে, ব-অ-অ-ড় ঠাকুর। বড় মানে কী? ঠাকুর কাকে বলে? প্যান্ডেল কী বস্তু? সিংহ কেমন হয়? কাকে বলে অসুর? সব অন্ধকার! মনে হত, অচেনা সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে সবাই আশপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। ক্রমশ জীবনের ‘এক্সপোজার’ অনুমান করতে শেখাল। |
একটু বড় হয়ে কত বার প্রতিমা তৈরির সময় পোটোপাড়ায় গিয়েছি। চারিদিকে মাটি-খড়ের ঝিম ধরানো গন্ধ। আঙুলে মাটি মেখেছি। চক্ষুদানের সময় তুলির কোণটা ছুঁয়ে থাকার আবদার করেছি শিল্পীর কাছে। গায়ে কাঁটা দিয়েছে। মাঝেমাঝে মনে হয়, দুর্গাঠাকুর কথা বলতে পারলে বেশ হত। কণ্ঠস্বর দিয়ে তাকে আরও ভাল ভাবে অনুমান করা যেত। আবার ভাবি, এই ভাল। দৃষ্টিহীন দুনিয়ায় সাকার-নিরাকার সব একাকার। কোনও বিবাদ নেই।
এখন তোমাদের অনুভবে দুর্গাঠাকুর ঠিক কেমন?
জমায়েতটা একটু থমকায়। তার পর বোঝাতে থাকে এই লম্বা-চওড়া-উঁচু চেহারা, আমাদের চোখের থেকে অনেক বড় দু’টো চোখ। আবার কপালের উপর তিন নম্বর চোখটা। নাকটা এই আমাদের থেকে অনেকটা চোখা। লম্বা চুল, শাড়ি পরা। আমাদের দু’টো হাত আর মা দুর্গার দশটা। সিংহের উপর থাকে, পাশে পায়ের কাছে মহিষাসুর। আমাদের স্কুলের ‘কনসেপ্ট ফরমেশন রুম’-এ দুর্গামূর্তি হাত বুলিয়ে দেখেছি। দুর্গার থেকে সিংহ আর অসুরের গা-টা একটু খসখসে। দু’জনের গায়ের রঙের গন্ধও আলাদা। আবার মণ্ডপে বসানোর পর মূর্তির গন্ধ পাল্টে যায়। আসলে তখন ধূপধুনো-নতুন জামাকাপড়-পারফিউম-খাবারদাবারের গন্ধ মিশে যায়। আর মণ্ডপের যে জায়গাটায় দাঁড়ালে মুখে সবচেয়ে বেশি আলোর তাপ আসে, আমরা বুঝতে পারি সেটাই হল দুর্গার একেবারে সামনাসামনি।
আলো, আলো..... পুজোর রোশনাইকে চোখের আঁধার নিয়ে ছোঁয়া যায়?
উত্তর আসে, ‘আলো’ মানে শুনেছি যাতে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়। আমরা আলো আর অন্ধকারের আলাদা গন্ধ বুঝতে পারি। পুজোর সময় হাজার-লক্ষ আলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটার সময় মুখে-গায়ে-হাতে সেই আলোর তাত লাগে। চার পাশে কত মানুষের কত রকম আওয়াজ। ঢাক-মন্ত্র-মাইক-বেলুনের খসখস, চুড়ি-ফেরিওয়ালার হাঁক, নতুন কাপড়ের গন্ধ, জুতোর ফোস্কা, খাবারের দোকানের গন্ধ, হাতাখুন্তির আওয়াজ, কান-ঝালাপালা ভেঁপু। আমাদের দুর্গাপুজো মানে এই আওয়াজ, এই গন্ধ, এই আবহটাই। এটাই উৎসব উদ্যাপন।
বেশির ভাগ মানুষ ভাবেন, পুজোর ভিড়ে আমরা বার হতে চাই না। ধুর! পাহাড়ে ট্রেক করছি, সমুদ্রে নৌকো চালাচ্ছি, আর দুর্গাপুজোর রাতে প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে ঘুরব না! যত ভিড় হয় তত মজা। এ বছর শুনছি দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্রেইল পুজো গাইড তৈরি হয়েছে। যাক, তবু লোকে অন্য রকম করে ভাবতে শিখেছে।
জানেন, পুজোয় বেড়ানোর জন্য পছন্দ করে জামা কিনি আমরা। ভাল লাগা বিভিন্ন রঙের জামা। লা-আ-আ-ল, সবুজ, নীল, সাদা, হলুদ, আরও কত। লাল মানে তো সাংঘাতিক উজ্জ্বল একটা ব্যাপার, সাদা মানে শান্তি-শান্তি অনুভূতি, সবুজ মানে তরতাজা ভাব, নীল খুব গভীর। এক একটা রঙের স্পর্শ এক এক রকম। হাত বোলালে বোঝা যায়। কালো রঙে আমাদের আটকে রাখা যাবে না।
স্কুলের অধ্যক্ষ বিশ্বজিৎ ঘোষ। এখানকারই প্রাক্তন ছাত্র। নয় বছর বয়সে মস্তিষ্কের রোগে দু’চোখের দৃষ্টি চলে যায়। একেবারে ছোটবেলায় দুর্গাঠাকুর দেখার ক্ষীণ স্মৃতি তার রয়েছে। তবে প্রায় চল্লিশ বছরের অদর্শনে এখন অনেক চেষ্টা করেও প্রতিমার মুখটা পুরোপুরি মনে করতে পারেন না জানালেন। তাঁর অভিজ্ঞতায়, আগে দৃষ্টিহীন ছেলেমেয়েদের এক বার হস্টেলে ঢোকাতে পারলে মানুষ যেন গলগ্রহ দূর করত। পুজোর ছুটিতে নিতে আসত না, এমন অনেক পরিবার ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারে বা সমাজে দৃষ্টিহীনদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়েছে। বেশির ভাগ ছেলেই বাবা-মা-আত্মীয়দের সঙ্গে মণ্ডপে যায়। টানা পাঁচ দিন শয়নে-স্বপনে ভরে থাকে পুজো।
স্বপ্ন দেখো?
বিলক্ষণ! কত রকম! কিন্তু সেই স্বপ্নে কোনও ‘ছবি’ দেখা যায় না। সেই স্বপ্নে শুধুই অনুভব আর শব্দ।
মা দুর্গা আসেন সেই স্বপ্নে?
দুর্গা যেহেতু স্বরহীন, তাই তাঁর স্বপ্নে জায়গা পায় শুধুই স্পর্শের অনুভব আর গন্ধ। অনেক পুজো-আয়োজকই বিসর্জনের আগে মূর্তি ছুঁয়ে দেখার অনুমতি দেন। দুর্গার তেলপালিশ মুখে আঙুল বুলিয়ে, অসুরের হাঁয়ে হাত ঢুকিয়ে, সিংহের কেশর এলোমেলো করে, ত্রিশূলের ধার পরখ করে চলে ‘দেখা।’। কানে আসে ‘আসছে বছর আবার হবে’। তার পর ঝুপ ঝুপ, জলে প্রতিমা পড়ার শব্দ। পায়ে গায়ে ছিটকে আসে চলকে ওঠা জল। মাটির মূর্তি জলে মিশে যাওয়ার সময় হাওয়ায় একটা আলাদা গন্ধ আসে। আশপাশের লোককে স্পর্শ করলে তখন একটা দুঃখের ‘ভাইব্রেশন’ পাওয়া যায়। আবার কবে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক বাড়বে, জন্য প্রতীক্ষা শুরু হয়। |