সম্পাদকীয়...
কহিতে কথা বাধে
পঁচিশটি দেশের প্রায় আঠারো হাজার মানুষের মধ্যে সমীক্ষা চালাইয়া সিদ্ধান্ত হইল: অধিকাংশ লোক কোনও স্পর্শকাতর কথা জানাইবার ক্ষেত্রে, তাহা মুখে না বলিয়া ই-মেল অথবা এসএমএস-এ বলা পছন্দ করেন। এই প্রবণতা সর্বাধিক চিন দেশে। তালিকায় ভারত চতুর্থ স্থানে। বিশ্বে গড়ে ৪৩% মানুষ এই অভ্যাসের বশবর্তী, ভারতে ৬৯% লোক। প্রবণতাটির হেতু সহজেই বোধগম্য। একটি কথা মুখোমুখি বলিলে অপর মানুষটির প্রতিক্রিয়া দেখিতে ও তাহার তাৎক্ষণিক ফল ভুগিতে বাধ্য থাকিতে হয়। হয়তো বহু তিরস্কার হজম করিতে হয়, চড়-চাপড়ও জুটিতে পারে। হয়তো অপর ব্যক্তি এমন কান্নাকাটি বা চিৎকার জুড়িয়া দিল, রেস্তরাঁ-র সকল লোক হাঁ করিয়া তাকাইতে লাগিল, ‘ধরণী দ্বিধা হও’ মোক্ষম সংলাপ হিসাবে প্রতিভাত হইতে থাকিল। মোবাইল বা আন্তর্জাল যখন আবিষ্কৃত হয় নাই, তখনও প্রেম জানাইবার প্রক্রিয়াটিতে মৌখিক প্রস্তাবের অপেক্ষা ক্ষুদ্র চিরকুটের ব্যবহার ছিল সমধিক। বহু ক্ষেত্রে দৌত্য করিত কোনও বন্ধু। এক দিন দেখা করিয়া ‘তোমাকে অমুক বড় ভালবাসিয়াছে’ বার্তা দিয়া মিটিমিটি হাসিত। প্রেম ভাঙিবার ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ কিছু না বলাই শ্রেয় বলিয়া মনে করিত। এক দিন না এক দিন ওই পক্ষ ঠিকই বুঝিয়া লইবে, ভাবিয়া সঙ্গীকে এড়াইয়া চলিত। এই সকল বিষয় আগাম ভাবিয়াই নিশ্চয় মোবাইল ফোন নির্মাণ করা হইয়াছে। একটি দূরভাষ যন্ত্রে আদৌ লিখিত বাক্য প্রেরণের সুবিধা থাকারই তো আপাত ভাবে কোনও প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু মানুষের কথা বলিবার যত প্রয়োজন, গুরুত্বপূর্ণ কথা না বলিয়া মনোভাব জানাইয়া দেওয়ার প্রয়োজন ততই এই বোধ আবিষ্কারটিকে সফলতর করিয়াছে। ই-মেল একই কর্ম করিয়া থাকে, মুহূর্তমধ্যে বার্তাটি জানাইয়া দেয়, প্রেরক নাগালের মধ্যে থাকে না, ফলে তাহার ললাট বা গণ্ড এবং অবশ্যই হৃদয় নানাবিধ প্রত্যাঘাত হইতে সহজেই বাঁচিয়া যায়। ব্রিটনি স্পিয়ার্স তাঁহার সঙ্গীর সহিত সম্পর্ক ভাঙিয়াছিলেন এসএমএস-এর মাধ্যমে। চুম্বনপ্রার্থনাও নিশ্চয় বহু বার ওই উপায়েই করিয়া থাকিবেন।
প্রকৃত নীতিকথাটি হইল: মানুষ ভীরু প্রাণী। সে কাজটি করিবে, কিন্তু তাহার দায় লইতে ডরাইবে। সে প্রেমের প্রস্তাব দিবে, কিন্তু সরাসরি প্রত্যাখ্যানের প্রত্যক্ষ অভিঘাত সহ্য করিতে প্রস্তুত থাকিবে না, বরং ফোনের দিকে তাকাইয়া ফ্যান্টাসি-প্রহর গুনিবে। সে সম্পর্ক স্থাপন করিবে, বৎসরের পর বৎসর তাহা যাপন করিবে, তাহার পর সঙ্গীটিকে ছাড়িয়া যাওয়ার হৃদয়বিদারক সিদ্ধান্তটি তাহার সম্মুখে বসিয়া জানাইবার সৎসাহসটি রাখিবে না, নিরাপদ দূরত্বে বসিয়া কতকগুলি অক্ষরের আড়ালে আশ্রয় লইয়া ভাবিবে, ঝড়টি যেমন-তেমন করিয়া কাটিয়া যাউক! ছাত্রটি ‘বাবা, আমি ফেল করিয়াছি’ লিখিয়া ফোন বন্ধ রাখিয়া হেদুয়ার ধারে বসিয়া থাকিবে। এই পলায়নী মনোবৃত্তি অধিকাংশ মানুষেরই মজ্জাগত, কেহই নাই যাহার অশান্তি বা ব্যর্থতা মুখরোচক মনে হয়। কিন্তু সত্তার এই আড়ষ্টতাকে অতিক্রম করিয়া যে নিজ কর্মের পরিণতির মোকবিলা করিতে প্রস্তুত থাকে, সে প্রকৃত চরিত্রবলের পরিচয় দেয়। ভয় স্বাভাবিক, অন্য লোক আমার কারণে আঘাত পাইলে তাহার সম্মুখে যাইবার ও বেদনাদানের দায় স্বীকার করিবার সময় হাত-পা উদরমধ্যে সেঁধাইয়া যাওয়াই বিবেকসম্মত। কিন্তু তাহা জয় করিবার শিক্ষা ও চর্চাই সভ্য হইয়া উঠিবার একটি আবশ্যক উপাদান। কিন্তু সহজ কথা: সভ্য হইতে মানুষের বহিয়া গিয়াছে। সাধারণ মানুষের আত্মসমীক্ষার পূর্ণ অভাব তাহাকে আত্ম-তিরস্কারের শাস্তি হইতে মুক্তি দিয়াছে। নীতি নহে, তাহার মনোযোগের বিষয় কেবল ভীতি। তাহার একমাত্র চিন্তা: এই অবিবেচক অননুকম্পায়ী ভবযাত্রায় প্রতি মুহূর্তে তাহার নিজ ত্বক নিরাপদে থাকিতেছে কি না। সেই লক্ষ্যে তাহাকে আধুনিক প্রযুক্তি বহু দূর আগাইয়া লইয়া যাইতেছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.