প্রবন্ধ ২...
সাইকেলে দুর্গা, ক্যারিয়ারে কার্তিক
রূপকথার গল্পের কার্তিক আর সরস্বতীর মতো সেই ফুটফুটে ভাই-বোন। সৎমায়ের প্ররোচনায় বাপ তাদের বনে দিয়ে এল। কিন্তু তারা ফিরে এসেছিল তাদের ফেলে যাওয়া চিহ্ন দেখে। পথের ধারে ধারে তারা ছড়িয়ে রেখেছিল নুড়ি। কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে, কেউ আছে, কেউ নেই: এ সব তো ছেলেবেলা থেকেই চিহ্ন দিয়ে বুঝি, খুঁজিও। দুর্গাপুজোর যাওয়া আসাও তো কতগুলো চিহ্নের ওপরেই ভর করে আছে। তবে খেয়াল করে দেখেছি চিহ্ন কিন্তু বদলে বদলে যায়। এখন দুর্গাপুজো যে সব চিহ্নের রথে চেপে ধরা দেয়; সেই সব উজ্জ্বল সমারোহময় প্যান্ডেল, হোর্ডিং, সাত তাড়াতাড়ি পুজোসংখ্যা, ভিড়-ভিড় মল কিছুই ছিল না। ছিল অন্য অনেক কিছু। অন্য রকম অনেক চিহ্ন।
টিন আর অ্যালুমিনিয়ামের সুটকেস নিয়ে আমরা পায়ে পায়ে ইস্কুল যেতাম। বড় রাস্তা দিয়ে যাওয়া নিষেধ। আমাদের শরীর তখন খাঁচাগাড়িতে পুরো ধরত না। আবার এতটাও বড় হয়ে যায়নি যে ভরসা করে ছেড়ে দেওয়া যায় সাইকেলে। ফুল প্যাডেল করতেও পারতাম না। কোনও রকমে হাফ প্যাডেল। ফলে আমরা সেই না-ছোট না-বড়র দল পায়ে পায়ে সকালবেলার ইস্কুল যেতাম পুলিশ ফাঁড়ির মাঠ ঘুরে, আধভাঙা পাঁচিলের ফাঁক গলে। ফাঁড়ির পিছনে একটা খাটিয়ায় দু’জন পুলিশ বসে থাকত। এক জনের বেশ বাহারে, গালে পাকানো গোঁফ। অসুরের সঙ্গে মিলও ছিল। তবে আলাদা করে কোনও রোমাঞ্চ হত না। কারণ তাকে তো সারা বছরই দেখা যায়। শুধু নতুন ভাবে সেজে উঠত একখানা গাছ। পুলিশ ফাঁড়ির ভাঙা পাঁচিলের গায়ে একখানা শিউলি গাছ। তার সঙ্গে মাকড়সা আর শুঁয়োপোকাদের খুব বন্ধুত্ব। শুঁয়োপোকাদের পছন্দ করতাম না। কিন্তু মাকড়সার জাল বোনা দেখতে খুব ভাল লাগত। শিউলি গাছের এ ডাল ও ডাল বেয়ে জাল বুনত মাকড়সা। সকালবেলা সেই জাল বোনা দেখে খুশি হয়ে শিউলি গাছ টুপটাপ ফুল ছড়াত। সেই মাটিতে ছড়ানো ফুলের একটা দুটো আটকে যেত শিশিরমাখা জালে। দূর থেকে মনে হত শূন্যে ঝুলছে একটা ফুল, দুটো ফুল। নরম রোদ আভা লাগাত তাদের গায়ে। আর সেই ইস্কুল যাওয়ার পথে বুঝতাম যাওয়া আসার সময় হল। যাবে খাটিয়ায় বসে থাকা গুঁফো পুলিশ। তার বাড়ি পাশের রাজ্যে, পুরুলিয়ায় এসেছে চাকরি করতে। পুজোর সময় সেই মহিষাসুর গোঁফ পুলিশ বাপের বাড়ি যায়।
আর সে আসে দুর্গামেলার মাঠে। পিছনের গ্রিল দিয়ে ঘেরা চাতালে পরদা ঝুলিয়ে ঠাকুর তৈরি চলছে। সামনের মাঠে তিন দিন তিন রাত সাইকেলে একটানা ঘুরপাক খেত মস্ত ওস্তাদ। ব্যস্ত সাইকেলওয়ালা। খেলা দেখায়। পুজোর আগে তার ব্যস্ততার শেষ থাকে না। টাকা পয়সা রোজগারের এই তো সময়। তার এক বাচ্চা শাগরেদ ছিল। আমাদের মতো হাফপ্যান্ট। সকালের স্কুল ফেরতা আমরা দুর্গামেলার মাঠে। ওস্তাদ সাইকেল চালাতে চালাতেই চান করত, জামা পরত, ভাত খেত। সে সব দেখার মতো দৃশ্য। সাইকেল চালাতে চালাতে ওস্তাদ একটা একটা করে বোতাম খুলে গায়ের জামায় টান দিত। জামা হাতে এলেই এক হাতে ছুড়ে দিত বাচ্চা শাগরেদের দিকে। বাচ্চা লুফে নিত। মেলে দিত গাছের ডালে। জামার বদলে নিয়ে আসত জলভরতি বালতি। সাইকেল গতি কমাত। ওস্তাদের দিকে জল ছোটাত হাফপ্যান্ট। কয়েক বার। শেষ বালতি নিজেই হাতে তুলে নিত ওস্তাদ। সার্কাসের হাতি যেমন শুঁড়ে করে বালতি তোলে তেমন। এক হাতে শেষ বালতির জল ঢালত মাথায়। তার পর ভিজে গায়ে পাক দিত। রোদে রোদে গা শুকোত। বাচ্চা দুর্গামেলার কাকুদের কাছ থেকে একটা থালায় ডাল-ভাত-তরকারি-ডিম নিয়ে আবার পায়ে পায়ে এগিয়ে যেত ওস্তাদের কাছে। ওস্তাদ সেই থালা এক হাতে নিত। পর ক্ষণেই আমাদের পলক পড়ার আগে ওস্তাদ অন্য হাতও হ্যান্ডেল থেকে তুলে নিত। হ্যান্ডেল ছেড়ে যে সাইকেল চালানো যায় তা দেখে আমাদের চোখে চোখে ঝিলমিল ঝিলমিল। সাইকেল চলছে শুধু পায়ের চাপে। ওস্তাদ খাচ্ছে। ভিড়ের হাততালি। পয়সা পড়ছে টুপটাপ।
দুপুরবেলায় মা বসত ক্যালেন্ডার কাটা ঠাকুরদের বাঁধানো ছবি নিয়ে। তাদের মুছতে হবে। ছেলে ঠাকুরদের সিঁদুর পরানোর বালাই ছিল না, মেয়ে ঠাকুরদের পরাতে হত। ক্যালেন্ডার-ঠাকুরের ছবির পিছনে দুটো টিকটিকি থাকত। মায়ের পরিষ্কারের জ্বালায় টিকটিকি দুটো পুজোর ক’দিন চালের টিনের পিছনে উঠে যেত। বুঝতাম পুজো আসছে মানে বেশ একটা চলাচল। পুলিশ বাড়ি যাচ্ছে, সাইকেলওয়ালা আসছে, শিউলি ফুটছে, মাকড়সার জাল শিশির মাখছে, টিকটিকিরা চালের টিনের বাসায় উঠে যাচ্ছে।
তিন দিন সাইকেল চালিয়ে পয়সা নিয়ে সাইকেলওয়ালা চলে গেল। বাচ্চা শাগরেদও গেল পিছু পিছু। ওই চাকরিটা খালি হলে আমাদের মধ্যেই কেউ সেটা পেতে পারে। নিচু গলায় উত্তেজিত আলোচনা চলে, যাতায়াতের পথে। পুজো আরও কাছে আসে। পুজো আসার আগেই এক দিন রাত-স্বপ্নে তারা চলে এল। সাইকেলে। সিটে দুর্গা, পিছনের ক্যারিয়ারে কার্তিক, গণেশ। সামনের হ্যান্ডেলে লক্ষ্মী, সরস্বতী। পিছনে হাতে বালতি নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে অসুর। সেই স্বপ্নের চিহ্ন ঘুম ভাঙার পরেও সজীব ছিল। স্বপ্ন আসার পর এক-দুদিন ইস্কুল হল কি হল না। ছুটি পড়ে গেল। আর সত্যি সত্যি এই সব চিহ্নের ভেলা ডিঙিয়ে হাজির হল দুর্গাঠাকুর।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.