উন্নয়ন নিয়ে নিজের রাজ্যেই বিপাকে মোদী
চ্যালেঞ্জের মুখে নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত মডেল।
কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) দাখিল করা রিপোর্ট বলছে, মোদীর নিজের রাজ্যে এক তৃতীয়াংশ শিশু অপুষ্টির কারণে কম ওজনের শিকার। গত কাল রাজ্য বিধানসভায় পেশ হওয়া এই রিপোর্ট মোদী-বিরোধীদের হাতে বড়সড় অস্ত্র তুলে দিয়েছে। কারণ, হিন্দুত্ব প্রসঙ্গ আপাতত পিছনে ঠেলে উন্নয়নের কথা বলেই দিল্লি জয়ের লক্ষ্যে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন মোদী। সিএজি রিপোর্ট সেই লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে বুঝে আজ পাল্টা তথ্য দিয়ে অভিযোগ খণ্ডনের চেষ্টা করেছে রাজ্য সরকার।
ঘটনাচক্রে আজই উপকূল নিরাপত্তা নিয়ে গুজরাত সরকারের সমালোচনা করেছে সিএজি। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে নৈকট্যের কারণে গুজরাত উপকূল খুবই স্পর্শকাতর। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা পরিকল্পনা পুরোপুরি রূপায়ণ করতে রাজ্য সরকার ব্যর্থ।’ জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রায়শই কাঠগড়ায় তোলা মোদীর পক্ষে এই পর্যবেক্ষণ যে বিড়ম্বনার, তাতে সন্দেহ নেই।
মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অপুষ্টি সংক্রান্ত যে অভিযোগ সিএজি এনেছে, তা সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প (আইসিডিএস) নিয়ে। ৬ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদাত্রী মা এবং ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের পরিপূরক পুষ্টি প্রদান, টিকাকরণ, স্বাস্থ্যপরীক্ষা এবং শিশুদের অপ্রথাগত শিক্ষাদানের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে এই প্রকল্প চালু করেছিল কেন্দ্র। সিএজি রিপোর্টে বলা হয়েছে, গুজরাতে ২ কোটি ২৩ লক্ষ শিশু এই প্রকল্পের অধীনে আসার হকদার হলেও এখনও ৬৩ লক্ষ শিশু বঞ্চিত। বছরে ৩০০ দিন পরিপূরক পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়ার কথা থাকলেও ১০০ দিনও দিয়ে ওঠা যায়নি। বয়ঃসন্ধি কালের মেয়েদের পরিপূরক পুষ্টি দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাজ্য পিছিয়ে।
নবরাত্রি উৎসবে মোদী। শনিবার আমদাবাদে। ছবি: পিটিআই।
বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার পরে জাতীয় নেতা হয়ে ওঠার চেষ্টায় হিন্দুত্বকে খানিকটা কম গুরুত্ব দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। অনেকের মতে, উন্নয়নের কথা বলে তিনি উদারপন্থী হিন্দু সমাজকে বার্তা দিতে চান। সেই কারণেই মোদী বলেছেন, মন্দির গড়ার চেয়ে শৌচালয় গড়া বেশি জরুরি। যা নিয়ে মোদীর সমালোচনা করেছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সভাপতি প্রবীণ তোগাড়িয়া। তাতে মোদীর লাভই হয়েছে বলে তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি।
উন্নত ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখাতে গিয়ে মোদীর হাতিয়ার তাঁর বহুচর্চিত গুজরাত মডেল। যে মডেলের পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক বিস্তর। অমর্ত্য সেনের মতো অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, গুজরাতের পথ ধরে দারিদ্র মোচন সম্ভব নয়। আবার জগদীশ ভগবতীদের বক্তব্য, গুজরাতই আদর্শ। বৃদ্ধির সুফল ক্রমশ চুঁইয়ে আসবে নিচু তলায়। অর্থনীতির এই বিতর্কের বাইরে মোদীর সাফল্যের দাবি ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্কও কিছু কম নয়। কংগ্রেসের বক্তব্য, গুজরাতের উন্নয়নের তত্ত্ব অতিরঞ্জিত। সিএজি-র রিপোর্ট তাদের বাড়তি উৎসাহ জুগিয়েছে। আর মোদী যখন উন্নয়নের কথা বলছেন, তখন দলকে তা নিয়েই আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন রাহুল গাঁধী। কংগ্রেস নেতা রাজীব শুক্ল বলেন, “মোদী গোড়া থেকেই রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন। আজ তাঁর ফানুস ফেটে গিয়েছে।”
সরব অন্যান্য দলও। মোদীর কারণে এনডিএ ছাড়া নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ-এর নেতা শিবানন্দ তিওয়ারি বলেন, “মোদীর কাছে দেশ মানে শুধুই কর্পোরেট। তাঁর রাজ্যে গরিবদের অবস্থা শোচনীয়।” আর সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাটের মতে, “গুজরাত মডেল যে আসলে কী, তা আজ প্রমাণ হল। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে গোটা দেশকে এ ভাবেই গুজরাত বানাবেন।”
মোদী মুশকিলে পড়েছেন বেহাল উন্নয়নের রিপোর্টটা সিএজি দেওয়ায়। ক’বছরে এই সিএজি রিপোর্টকেই অস্ত্র করে মনমোহনের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে বিজেপি। তা সে কয়লা কেলেঙ্কারিই হোক, বা টুজি কেলেঙ্কারি বা কমনওয়েলথ দুর্নীতি। ফলে এখন তাঁর পক্ষে সিএজি রিপোর্টকে নস্যাৎ করা কঠিন। এই অবস্থায় মোদীর নির্দেশে পাল্টা খতিয়ান তুলে ধরেছে রাজ্য সরকার। পাঁচ পাতার সেই খতিয়ানে সিএজি রিপোর্টকে ভুল বলা হয়নি, তার ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
মোদী সরকারের দাবি, খোদ সিএজি-ই গত বছর অপুষ্টি রোধে গুজরাত সরকারের তারিফ করেছিল। জানিয়েছিল, ২০০৭-’১২ পর্যন্ত এই সমস্যা প্রায় ৩৯ শতাংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে রাজ্য। ফলে ২০১০-’১১ সালে কম ওজনের শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তার কারণ অন্য। কারণটা হল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) অপুষ্টির বিষয়ে তাদের মাপকাঠি বদল করেছে। রাজ্যও সেই মাপকাঠি অনুসরণ করায় সংখ্যাটা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। মোদী সরকারের বক্তব্য, নতুন মাপকাঠিতে অপুষ্টির শিকার শিশুদের উপরে নজর রাখার সুবিধা হচ্ছে। অতএব এ নিয়ে রাজনীতি করার কোনও প্রয়োজন নেই।
মোদী সরকারের দাবি, গোটা দেশে আইসিডিএস-এর অধীন শিশুদের ৩৬ শতাংশ কম ওজনের শিকার। গুজরাতে এই হার ২৭ শতাংশ। যেখানে কংগ্রেস-শাসিত রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং হরিয়ানায় এই হার যথাক্রমে ৩৩, ৩৯ এবং ৩৪ শতাংশ। গুজরাত সরকারের আরও বক্তব্য, সিএজি যে ৬৩ লক্ষ শিশু পরিপূরক পুষ্টির আওতার বাইরে থাকার কথা বলেছে, সেটা গত পাঁচ বছরের হিসেব। অথচ এটা বলা হচ্ছে না যে, এই পাঁচ বছরে পরিপূরক পুষ্টি পাওয়া শিশুর সংখ্যা ২৫ লক্ষ থেকে বেড়ে ৪৮ লক্ষ হয়েছে। আইসিডিএস প্রকল্প রূপায়ণে দুর্বলতার জন্য কেন্দ্রকেই কাঠগড়ায় তুলে গুজরাত সরকারের অভিযোগ, ২০১০ সালে ৩২৪৬টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র গঠনের অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল। মাত্র ১৯১১টির অনুমোদন মিলেছে।
আসলে মোদী বুঝতে পারছেন যে, সিএজি রিপোর্ট নিয়ে জাতীয় স্তরে প্রচার তাঁর লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে। অতীতে চন্দ্রবাবু নায়ডুর বিরুদ্ধেও একই রকম অভিযোগ উঠেছিল। হায়দরাবাদকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের অন্যতম গন্তব্যে পরিণত করেও ভোটে হারতে হয়েছিল তাঁকে। ২০০৪ সালে উজ্জ্বল ভারতের কথা প্রচার করে হেরেছিল বিজেপি-ও। মোদী তাই সতর্ক। কংগ্রেসের ‘আম-আদমি’ স্লোগানের বিপরীতে তিনি যাতে শুধু কর্পোরেট দুনিয়ার বন্ধু হিসেবে পরিচিত না হন, সে জন্য মোদী এখন গরিবগুর্বোদের উন্নয়নের কথাও বলছেন। তিন দিন আগে দিল্লি এসে মন্দিরের আগে শৌচালয় গড়ার কথা যেমন বলেছেন, তেমনই নিজের রাজ্যে আনন্দে গিয়ে কবুল করেছেন যে, গুজরাতে শিশুরা এখনও অপুষ্টির শিকার। যা দেখে তাঁর কষ্ট হয়।
মোদীপন্থীরা অবশ্য মনে করছেন, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কোনও রিপোর্ট পেলে বিজেপি যতটা শোরগোল তুলতে পারে, এই রিপোর্ট নিয়ে ততটা সরব হওয়ার দমই নেই কংগ্রেসের। যে সত্যটা কংগ্রেস নেতারাও কবুল করছেন। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, রাহুলের সাম্প্রতিক গুজরাত সফরের কথা। যেখানে মোদীর বিরুদ্ধে সরব হওয়ার বদলে অর্ডিন্যান্স নিয়ে নিজের অবস্থানের সাফাই দিয়েছেন তিনি। সেখানেও ‘মা বলেছেন।
আমার বয়সটা কম তো’ ইত্যাদি বলে নিজের অনভিজ্ঞতাকেই প্রকট করেছেন। যা নিয়ে এখন উপহাস করছে বিজেপি।
কিন্তু ঘটনা হল, গুজরাতের যে ছবি সিএজি তুলে ধরেছে, তাতে শুধু কংগ্রেস নয়, বিজেপি-র মোদী-বিরোধীরাও খুশি। তাঁদের মতে, গুজরাত মডেলের অসারতার যে কথা তাঁরা বলে আসছিলেন, সেটাই প্রমাণিত হল। যদিও দলের তরফে সরকারি ভাবে আজ মোদীর পাশেই দাঁড়ানো হয়েছে। বিজেপি মুখপাত্র মুখতার আব্বাস নকভি বলেছেন, “কংগ্রেস সব সময় গুজরাতকে খাটো চোখে দেখে। এই সমস্যা যখন গোটা দেশের, তখন গুজরাতকে আলাদা করে দেখার মানে কী!”

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.