পুস্তক পরিচয় ২...
‘নিত্যনতুন হবে তোমার খুব-পুরোনো দেশ’
দুর্গাপুজো পুরনো হবে কি কোনও দিন? ইন্টারনেট, আইফোন, ট্যাব কি রিয়েলিটি শো-র বহর তাকে একবিন্দু পিছু হটাতে পারেনি। মা আসছেন স্বমহিমায়, শরতের আকাশে সাদা মেঘ আর কাশফুল শুধু নয়, এই শিউলিফোটা সময়ে আরও এক আগমনী সুর শারদ সাহিত্যে। সিলেবাসের বাইরে খানিক অবকাশে যদি অন্য পড়ায় খেলার আনন্দ পায় ছোটরা, সেই আশায় বুক বেঁধেই সযত্নে প্রকাশিত ঝালাপালা (সম্পা: অশোককুমার মিত্র)। ‘হারানো দিন চিরনবীন’ পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ, কুমুদরঞ্জন মল্লিক থেকে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রবীণ পাঠকের স্মৃতিময় পরিসর রচনার পাশেই কবিতা, গল্পের উপচে পড়া ভাণ্ডার। রয়েছে সৌমিত্র বসুর নাটক ‘কুমির ডাঙ্গা’। রতনতনু ঘাটির কবিতা ‘ওলটপালটপুরে’ শৈশব, বড় হওয়া, পরিবার, সম্পর্ক ঘিরে এক অপূর্ব কথকতা
‘বড়োরা তো ভারতবর্ষ! পৃথক হচ্ছে কেন?
পারলে ওদের মিলিয়ে দাও, এক হয়ে যায় যেন!’

কঠিন বাস্তবের সঙ্গে কিশোর মনের স্বপ্নসম্ভবপরতা যখন মিলে যায়, ছোটদের জন্য লেখায় বড়দেরও পুনর্জন্ম ঘটে এমন করেই পড়া হয়ে যায় ‘সূর্যাস্তের ছবি’ (চন্দন নাথ), ‘আকু বাকু উকি টুকি’ (অমর মিত্র), ‘কাইট মানে ঘুড়ি, কাইট মানে’ (কিন্নর রায়) প্রভৃতি গল্প। বিজন কর্মকারের প্রচ্ছদ ও ইন্দ্রনীল ঘোষের অলংকরণ মন টানে।
দুটি উপন্যাস, তিরিশটি গল্প, বাইশটি ছড়া-কবিতা, দুটি নাটক, তিনটি কমিকস দিয়ে ভরা আমপাতা জামপাতা (সম্পা: দেবাশিস্ বসু)। শৈলেন ঘোষের ‘বনসবুজের আয়নায়’ মন ভাল করে দেয়। সুভাষ ভট্টাচার্যের ‘সহজে ব্যাকরণ’ পড়ে শিক্ষকদের প্রাপ্তিযোগ হলে ভাল। এমনই কাজের পীতম ভট্টাচার্যের ‘ছোটদের আবৃত্তিচর্চা’। আশিসকুমার মুখোপাধ্যায়ের নাটক ‘খুশির রং’-এর চরিত্ররাই একেকটি রং। সে কালের বাঁধানো পূজাবার্ষিকীর মেজাজ আছে এই বইয়ে। যোগেন চৌধুরীর প্রচ্ছদ, গণেশ পাইন, সত্যজিৎ রায়ের ছবি ছাড়াও চণ্ডী লাহিড়ী, চারু খান, কৃষ্ণেন্দু চাকী সহ অনেকে সাজিয়েছেন আমপাতা জামপাতা। শারদীয় শুকতারা-য় (সম্পা: অরুণচন্দ্র মজুমদার) উপন্যাস ও গল্পের বিপুল আয়োজন। ফিরে পড়া লীলা মজুমদারের ‘পুলিশের প্রমোশন’ গল্পটি। হিউলেট-প্যাকার্ড কোম্পানির শতবর্ষে শ্যামল চক্রবর্তীর ‘দুই বন্ধু ও একটি গ্যারাজ ঘর’ সময়োপযোগী। ‘সন্তোষপুরের সেই বাড়িটা’য় যে অহিংস বোমার কথা রয়েছে তা এখন সব শান্তিকামী মানুষেরই অস্ত্র হওয়া দরকার। চিরপরিচিত ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ আতঙ্কবাদীদের জব্দ করছে আর ‘হাঁদা-ভোঁদা’ এ বার হাতে হাত মিলিয়ে চাঁদা-আদায়কারীদের দমন করছে!
টগবগ-এ (সম্পা: সরল দে) গল্প-ছড়া-কবিতার সঙ্গেই গুরুত্ব পেয়েছে হাতে আঁকা ছবি। রুচিরা মজুমদার পালের ছবিতে ‘আমাদের দাবী মানতে হবে খেলার সময় দিতে হবে গল্পের বই পড়তে দিতে হবে, দিতেই হবে’ লেখা পোস্টার নিয়ে ছোট ছেলেমেয়েরা আন্দোলন করছে, সত্যিই এর সময় এসে গিয়েছে। গোটা সংকলনটিই সুন্দর সুব্রত চৌধুরী, প্রণব হোড়, সুব্রত মাজির অলংকরণে, শংকর বসাকের প্রচ্ছদে। গল্প অনেক, খুব ছোটদের নিয়ে বসে পড়ে শোনালে আনন্দ দ্বিগুণ হবে। সুখপাঠ্য ‘এক পাহাড়ি কিশোরের স্বপ্ন’ (মুকুল মাইতি), বা ‘ভ্যাকুয়াম’ (দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়)। উৎসব উদ্যাপনের ইচ্ছে অন্য ভাবে জাগায় সূর্যদীপ মুখোপাধ্যায়ের ‘অদ্ভুতুড়ে সম্মেলন’।
‘উদ্ভাস শিশু ভাবনা কেন্দ্র’র শারদ চাঁদের হাসি-তে (সম্পা: ছন্দা চট্টোপাধ্যায়) খুদে পাঠকদের জন্য মহোৎসব। ঝকঝকে পাতায় আরও অনেক গল্প-কবিতার মতো বন্ধু-র ‘আপ্পু-পাপ্পুর আজব দুনিয়া’, ‘লাল চড়ুই’ (কালিদাস ভদ্র), ‘শেষ দৃশ্যটা’ (সুকুমার রুজ), ‘কানা নদীর বন্ধু’ (কার্তিক ঘোষ) ভারি ভাল। শারদীয় শতদ্রু-র (সম্পা: লোকেশ হোম রায়) ছবি-ছড়া-কবিতা শুধু বড়দের সৃষ্টি নয়, ছোটরাও সমান সৃষ্টিশীল। ‘স্কুলবাস’ (সিদ্ধার্থ সিংহ) গল্পে ছোট্ট অংশিকের স্বেচ্ছায় নিজের দায়িত্ব নিতে চাওয়ার ইচ্ছেটা বড়দেরও ভাবাবে। কিশোর দুনিয়া-য় (সম্পা: তাপস মুখোপাধ্যায়) শিশু-কিশোর সাহিত্যিক ধীরেন্দ্রলাল ধর-কে জন্মশতবর্ষে স্মরণ করেছেন মহুয়া ভট্টাচার্য গোস্বামী, আছে অনেক গল্প-কবিতা-ভ্রমণ। ছোটদের কচিপাতা (সম্পা: সমর পাল) ‘চিরকালের সেরা’ বিভাগে ফিরিয়ে এনেছে রেভারেন্ড লালবিহারী দে-র ‘শাঁকচুন্নির কাণ্ড’। ‘জাত-বেজাতের প্রশ্নে বিবেকানন্দের বিবেক’ (সৈয়দ রেজাউল করিম) উল্লেখ্য। আগরতলার ছোট্ট ঝিনুক (সম্পা: বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী) শৈশবস্মৃতি চয়নে অন্য মাত্রা এনেছে।
শারদীয় কিশোর ভারতী-তে (সম্পা: ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়) কল্প-ইতিহাসের ‘আবু হাটির অবাক মেলা’ (সৈকত মুখোপাধ্যায়), নির্ভেজাল মজার ‘বলহরি চিটফান্ড’ (শক্তিপদ রাজগুরু), ‘বারুইপাড়ার বারুদ’ (বাল্মিকী চট্টোপাধ্যায়), কমিকসে ধাঁধাঁ ‘চেক সমস্যা’ (সোমনাথ রায়) ও ‘আনন্দের সন্ধানে’ (মহুয়া দাশগুপ্ত), আরও অনেক লেখার ভাণ্ডারে ‘ইচ্ছেপ্রদীপ’ (শঙ্খ ঘোষ) আপনি জ্বলে, সেই সহজ খুশির উপহার শুধু ছোটদের নয়, বড়দেরও। ‘ছুটি সিরিজ’-এর ছুটির সময় (সম্পা: সুচিত্রা ভট্টাচার্য) গোয়েন্দা, রূপকথা, ভূত, ম্যাজিক, ইতিহাস, পুরাণ, অ্যাডভেঞ্চারে টইটম্বুর সম্ভার। পার্থ মণ্ডল, তমাল ভট্টাচার্য, পলাশকান্তি বিশ্বাস, পার্থ মৈত্র-র অলংকরণ ও অনিকেত রায়ের প্রচ্ছদে জমজমাট। ‘ফুটবল পেলে আর কথা নেই। অস্পষ্ট মনে আছে ঘরের ভেতর রবারের বলে লাথি মারতেন আমাকে খুশি করতে।’ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ছেলেবেলার স্মৃতিতে ডুব দিয়েছেন পৌত্রী কঙ্কণা বসু, হৈ হৈ-এর (সম্পা: দেবব্রত নিয়োগী) শারদীয় সংখ্যায়। সঙ্গে স্বয়ং সম্পাদকের পদ্যছন্দে নাটক ‘ইলিশ’, আর ছড়া-গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ। শিশুমেলা (সম্পা: অরুণ চট্টোপাধ্যায়, প্রচ্ছদ প্রণবেশ মাইতি) এ বারেও উজ্জ্বল গল্প, লোককথা, ছড়া-কবিতার ভরা সংসারে। কালো খসখসে একটা পাখি কেমন করে নীলকণ্ঠ হয়ে উঠল (‘দুর্গার দূত’, দীপান্বিতা রায়), দুটি বেড়ালছানার গল্প (‘ফাটিস’, শৈলেন ঘোষ), এমন অনেক লেখা ছবি মন ভরায়।
বিশ্বায়নের ফলে এখন আমরা আন্তর্জাতিক, মাউস নাড়ালেই আন্তর্জালে স্বেচ্ছা-নির্বাসন। এক নিমেষেই মুঠোয় পছন্দের সব কিছু। কিন্তু আমি-মানুষটার পায়ের তলার মাটি, সে-মাটির গন্ধ, নিজস্ব বর্ণমালার নরম, উষ্ণ ছোঁয়ায় ঘরে ফেরার স্বাদ সব মিলিয়ে যেন নিজেকে নিয়ে নিজের কাছে ফেরা ছোটদের শারদ-সাহিত্যের হাত ধরে।
‘এদেশ যদি আগলে রাখো
সতেজ রাখো প্রাণ
হারিয়ে যাওয়া সুরের যদি
ফিরিয়ে আনো রেশ—
... নিত্যনতুন হবে তোমার
খুব-পুরোনো দেশ।’

(শঙ্খ ঘোষ, ‘উপহার’, শিশুমেলা)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.