পুস্তক পরিচয় ১...
মালগুডির মতোই মূর্ত মাগুরা গ্রাম
উড়োজাহাজ, অধীর বিশ্বাস। গাঙচিল, চার খণ্ড একত্রে, ৭০০.০০
নিতাইমামার বিয়ে, মাগুরা টাউন থেকে এসে শতরঞ্চি পেতে ইংরেজি বাজনদাররা কনসার্ট দিচ্ছে, হ্যাজাকের আলোয় ঝলমল করছে বিয়েবাড়ি। বাস এসে যাবে বরযাত্রী নিয়ে যেতে, কিন্তু রতনের বাবা বলে গেছেন, বিয়েবাড়িতে যাবি না, নেমন্তন্ন নেই, পথেই নামবি না। রতন আর অসিত এক জনের দড়িভরা হাফপ্যান্ট আর ফাটাফুটো পুরনো জামা, আর এক জনের শুধুই গেঞ্জি। ওদের ক্লাসেরই গৌর-তপন ইংলিশ প্যান্টের ভিতর টেরেলিনের শার্ট গুঁজে, বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর রতনদের বলছে, অ্যাই, তোদের নেমন্তন্ন নেই। বাস এল, বরযাত্রীরা বাসে উঠে পড়ল। রতন আর অসিতও অন্ধকারে বাসের পিছনের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে পড়ল, যাতে কেউ না দেখতে পায়। গ্রাম ছাড়িয়ে, টাউন পেরিয়ে বাস চলছে, গাছের ডালের বাড়ি এড়ানোর জন্য রতন-অসিত জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেল। নিতাইমামার বাড়ির লোকেরা বেশি রাগারাগি করেনি, এসেই যখন পড়েছে! ছেঁড়া-জামা, খালি-পা ছেলেদুটোকে দেখে কনেবাড়ির লোকেরা ভাবল বাজনদারদের ছেলে। ওরাও বাজনদারদের সঙ্গে খায়, শোয়। বাস ফিরে এল গ্রামে। নেমন্তন্নের দিন সুধীরকাকা রতনকে নিতে এলেন। গ্রামের সবাইকে তো আর নেমন্তন্ন করা যায় না, তবে রতনের নেমন্তন্ন। চুপি-চুপি বরযাত্রীদের বাসে গিয়েছিল, ভালই তো।
রেজাল্ট নিয়ে রতন বাড়ি ফেরেনি। রতনের মা যাকে পান তাকেই জিজ্ঞেস করেন, রতনকে কেউ দেখেছে? না, কেউ দেখেনি। রতন কি ফেল করল? যে ছেলে হাফ-ইয়ারলিতে সেকেন্ড হয়, সে ফেল করবে? শীতের সন্ধ্যায় রতনের মা শুধু শাড়ি জড়িয়ে এবাড়ি-ওবাড়ি যান। একটা চাদর আছে, তুষের, ছেঁড়া-ছেঁড়া, পুরনো। সেটা রতনের মা বাক্স থেকে বের করেন না, বাবা রাগারাগি করলেও। দড়িতে ঝুলিয়ে রাখলে ইঁদুর এক রাতেই কুচিকুচি করবে। রতনের দাদা বের হল, শেষ পর্যন্ত বিশুকাকাকে ধরতে হবে, বিশুকাকা থানার চৌকিদার। রতনের বাবা নবগঙ্গার সাঁকোর উপর এপার-ওপার করেন। সাঁকোর পাটনি চৌধুরীকাকা শুধোন বার বার ইধার-উধার কোরছেন কেন, কোই আসবে? বাবা কেঁদে ফেলেন, ছেলে ঘরে ফেরেনি। ক্লাসের ছেলেরা বলে, রতনকে দেখেছে রেজাল্ট হাতে নিয়ে স্কুল থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে। পাশ করেছে? হ্যাঁ, হ্যাঁ, কল্পনার থেকে বেশি নম্বর পেয়ে ফার্স্ট হয়েছে। তা হলে? শেষ পর্যন্ত রতন বাড়ি ফিরল। গিয়েছিল শ্রীপুর গ্রামে কুণ্ডুবাড়িতে, হরিশদাদার বই বুক করতে। হরিশদাদা বইয়ে দাগ দেয় না, এ বার উঁচু ক্লাসে উঠল। অন্য কাউকে দেওয়ার আগে রতন যাতে বইগুলো পায় হাফ দামে, সে জন্য রতন দৌড়ে গিয়েছিল। হরিশদাদার বাবা জিজ্ঞেস করেন, রতনের বাবা কী করে? বাবা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কাজ করে। হরিশদাদার বাবা বলেছেন, বইগুলো রতনই পাবে, হাফ দামে না, বিনে পয়সায়। শুনে রতনের বাবা কেঁদে ফেলেন। বলেন, বাড়িতে বলে যাবি তো?
অলংকরণ: অঙ্কন ও অনন্য বিশ্বাস
সব ছেলেরই নাম রতন নয়। কেউ বুধো, কেউ তপন, শিবু, দীপু, গোলক। দশ-বারো বছরের ছেলে। এদের নিয়ে, এদের বাবা-মা দাদা-কাকাদের নিয়ে গল্প লিখে আসছেন অধীর বিশ্বাস। ১৯৭৬-২০১১ পর্যন্ত, তিরিশটি খ্যাত-অখ্যাত প্রকাশন সংস্থা থেকে তাঁর ১৬০টি টুকরো গল্প আর ২০টি বড় গল্প বেরিয়েছে। সেগুলো চার খণ্ডে (গাঙশালিকের বাসা, রঘু ডাকাতের দোকান, পানের বরোজে বাঘ, যাচ্ছি নিরুদ্দেশে) সাজিয়ে উড়োজাহাজ সংকলনটি তৈরি হয়েছে। গল্পগুলো পড়তে পড়তে আর কে নারায়ণের মালগুডির মতোই মূর্ত হয়ে ওঠে মাগুরা গ্রাম। তবে মালগুডি কাল্পনিক স্থান, মাগুরা যশোর জেলার মাগুরা মহকুমা শহর লাগোয়া গ্রাম। বেলতলা-আমতলা-আশশ্যাওড়ার জঙ্গল। নারকেল সুপুরি কলাগাছ। তুলসীতলার পাশে দোপাটি-র ঝাড়। টগর, গ্যাঁদা, শেফালি। পাকা বাড়ি কয়েকটা, বেশির ভাগই কাঁচা বাড়ি। বৃষ্টি পড়লে ল্যাঠা, মাগুর, ট্যাংরা ছিটিয়ে পড়ে মজা হয় বকদের, মাছরাঙাদের, জলঢোঁড়া সাপদের। চুনোপুঁটি মাছগুলো কোথায় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাবে ভেবে পায় না। প্যাঁচার ডাক আসে বুদ-বুদ-ভুতুম। কোলাব্যাঙ সোনাব্যাঙ ডাকে কট-কট-কটর, গ্যাঁগোঁ-কিরিকিরি। শুকনো কলার পাতায় কাক বসলে খরর-খরর শব্দ। পিঁপড়ে, আরশোলা, মাকড়সা, টিকটিকি সারাদিন খাবার খোঁজে। বাচ্চা কুটুমকে তাক করে আছে কাক, মা-কুটুম নিচু হয়ে ঢুকে পড়ে বাসায়, আর বাচ্চাটা চাঁও-চাঁও, চাঁ-চাঁ করে মায়ের পিঠে চড়ে বসে, কাক’কে এড়িয়ে মা-কুটুম উড়ে যায়, কুটুম-কুটুম-কুটুম ডাক ছেড়ে।
মাগুরা গ্রামের পাশেই মাগুরা টাউন। জুতোপট্টি, কোর্ট, পাকুড় গাছ, কোর্টের মাথায় জাতীয় পতাকা, জেলখানা, এসডিও-র বাংলো। মডেল স্কুল, অ্যাকাডেমি স্কুল, গার্লস স্কুল। ফাইনাল পরীক্ষা দিতে আসে দূর-দূরান্তরের স্কুলের ছেলেরা। অনেক দিন থাকতে হয়, লজিং নেয় মাগুরা গ্রামে। কম্পিটিশন চলে ঘরে ঘরে, কার লজিং বেশি ভাল রেজাল্ট করে। মাগুরার পাশ দিয়ে নবগঙ্গা নদী। নদীর কূল, ভাঙাচোরা পাড়। নদীর মাঝে বিরাট-বিরাট বাঁশ, বাঁশের মাথায় জাল। বাঘবন্দির মাপে ফাঁদ পেতে রেখেছে মাছের ব্যাপারীরা।
মাগুরা গ্রামের নিরন্নরাই মুখ্য চরিত্র অধীর বিশ্বাসের গল্পে। দু’বেলা ভাত জোটে না। একবেলা ভাত, খালে-বিলে ধরা চুনোমাছ থাকলে ভাল, না হলে লঙ্কা বেটে ভাত গিলে ফেলা পেট ভরানো নিয়ে কথা। এমনই এক ছেলে গোলক। গোলকের বাবা নরেনবাবুদের লিচুবাগান পাহারা দেয়। যা পায় তাতে সংসার চলে না, অন্য কাজ খুঁজতে হয়। তখন গোলক পাহারা দেয়, স্কুলের ক্লাস না থাকলে। গাছের টঙে বসে ঘণ্টা বাজিয়ে পাখি আর বাদুড় তাড়ায়। একদিন মালিক এসেছেন লিচুবাগানে, পাহারা কই? এক জন গাছে উঠে হিড়হিড় করে টেনে নামায় গোলককে। বাবু বিছানা পেতে বই-বুকে ঘুমোচ্ছিলেন। বই বুকে! স্কুলে পড়িস? হ্যাঁ, সেভেনে ওঠার পরীক্ষার পড়া পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আচ্ছা যা, অত ঘুমুলে লিচু থাকবে? গোলকের বাবার চাকরিটা থেকে গেল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.