জৈন সম্প্রদায়ের জমিদারবাড়িতেই পূজিতা হন দেবী দুর্গা।
সন্তান কামনায় এক সময় পাড়া ব্লকের পলমা গ্রামে জমিদার বাড়িতে যে পুজোর সূচনা হয়েছিল, গত ২৫০ বছরে তা এখন আশপাশের গ্রামের মানুষের পুজো হয়ে উঠেছে।
পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক ধরে রেল শহর আনাড়ায় ঢোকার মুখে পাকা সড়ক ধরে কিছু দূর গেলেই পড়বে পলমা গ্রাম। এখানেই ছিল কেষ্ট মাজির জমিদারি। তাঁরা আদতে জৈন ধর্মাবলম্বী সরাক সম্প্রদায়ের। কথিত রয়েছে, তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। এ নিয়ে দুঃখে ছিলেন জমিদারবাড়ির লোকজন। কেষ্ট মাজির মা এক দিন একটি পুকুর পাড়ে এ নিয়ে মনের দুঃখে কাঁদছিলেন। সেই সময় ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন ধানবাদের ভাড়ারির বাসিন্দা ভাগবত চক্রবর্তী। তিনি কেষ্ট মাজির মায়ের কাছে দুঃখের কথা শুনে দুর্গাপুজো করতে বলেন।
কিন্তু জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে হিন্দুদের দেবী পুজো করা সম্ভব ছিল না। শেষে ভাগবত চক্রবর্তী পলমাতে এসে প্রতিবছর দুর্গাপুজো করে যাবেন বলে জানিয়ে যান। পুজোর পরে সন্তান লাভ হয়েছিল কেষ্ট মাজির। সেই শুরু। আড়াইশো বছর ধরে এখনও ধানবাদ থেকে ভাগবত চক্রবর্তীর বংশধররা পলমা গ্রামে এসে প্রতি বছর দুর্গাপুজো করে যাচ্ছেন। দুর্গা মন্দিরের অদূরে বাড়িতে বসে সরাক সম্প্রদায়ের পুজোর ইতিহাস বলছিলেন ৮৭ বছরের বৃদ্ধ পুরুলিয়া জেলা স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ব্রম্ভ্রানন্দ মাজি। সন্তান লাভের আশায় জমিদার বাড়িতে পুজো শুরু হয়েছিল। এখনও সেই পুজো সাড়ম্বরে হয়ে আসছে। সেই বিশ্বাসও অটুট রয়েছে বাসিন্দাদের মধ্যে।
পুরুলিয়ার অন্যতম প্রাচীন এই সম্প্রদায় রাজস্থান থেকে মানবাজার এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করে। ব্রম্ভ্রানন্দবাবু জানান, মানবাজারে থাকার সময়ে তাঁদের সমাজের এক মহিলাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এক রাজা। কিন্তু সমাজের বাইরে সরাক সম্প্রদায়ের বিয়ে দেওয়ার প্রচলন নেই। তাই রাতারাতি মানবাজার থেকে সরাক সম্প্রদায় উঠে যায় পঞ্চকোট রাজ্যে। নতুন বসতি স্থাপন করা হয় পলমা গ্রামে। পুরুলিয়ার লোক গবেষক সুভাষ রায় বলেন, “তথ্য অনুযায়ী আকবরের সেনাপতি মানসিংহ ওড়িশা জয় করে বিহার যাওয়ার সময়ে তাঁবু ফেলেছিলেন মানবাজারে। সরাক সম্প্রদায়ের এক মহিলাকে দেখে তিনি বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে রাতারাতি এই সম্প্রদায় মানবাজার থেকে পঞ্চকোট রাজ্যে চলে যায়।” সরাক সম্প্রদায় পুজার প্রচলন করলেও কিন্তু পুজার আয়োজনের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে। ব্রম্ভ্রানন্দবাবু কথায় “পুজোর সংকল্প হয় আমাদের নামে। কিন্তু আমরা পুজোয় পুষ্পাঞ্জলি দিই না। শুধুমাত্র পুজোর আয়োজনের মধ্যেই আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখি।” বৈষ্ণব মতে এখানে পুজো হয়। পাশের বনবেড়িয়া, মহুলা, শ্যামসুন্দরপুর, জুরুডি, মইসরা গ্রামের বাসিন্দারা এই পুজো নিয়েই মেতে থাকেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার পুজোর জাঁকজমক কমে গিয়েছে। সেই জলুস এখন আর নেই। পলমা গ্রামের একদা জমিদার কেষ্ট মাজির বর্তমান বংশধর স্বপন মাজি, লিল্টু মাজি, কাজল মাজিরা বলেন, “জমিদারি আর নেই। তাই পুজোর সেই আড়ম্বরও এখন নেই। এখন যতটা সম্ভব রীতি বজায় রেখে আমরা পুজো করে যাচ্ছি।” |