বাড়ির অদূরে খোলা মাঠে যখন দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের বাঁশ পড়ত, তখন স্ত্রী-ছেলে নিয়ে দিদির বাড়ি রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করতেন রানিবাঁধের দারকেডি গ্রামের বাসিন্দা সুনীল হেমব্রম। আদিবাসীদের বুয়ান নৃত্য রানিবাঁধ ব্লকের দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ। সুনীলবাবু ছোট থেকেই এই নৃত্যকলা প্রদর্শনের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু, ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল মাওবাদী আতঙ্কের জেরে রানিবাঁধ-সহ বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের অন্য ব্লকগুলি পুজোর জৌলুস হারায়। বন্ধ হয়ে যায় বুয়ান নৃত্যও। তাই মনে একরাশ দুঃখ নিয়ে এই ক’বছর গ্রামের বাইরেই পুজো কাটিয়েছেন সুনীলবাবুর মতো জঙ্গলমহলের বহু মানুষ। |
এখন দিন বদলেছে। সুনীলবাবুও ফের রানিবাঁধমুখী। সারেঙ্গার বাজারে রাত ন’টার পরেও পুজোর কেনাকাটার ভিড় জমছে। সেই ভিড়ে সপরিবার দেখা যাচ্ছে সারেঙ্গা ব্লক সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরের গ্রাম বিক্রমপুরের বাসিন্দা শান্তিময় পাল, জয়ন্ত পালদের। এই দৃশ্য বছর দুয়েক আগেও অলীক কল্পনা ছিল বলেই জানাচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সন্ধ্যা নামার আগেই রাস্তাঘাট সুনসান হয়ে যেত। পুজোর বাজার সারতে দূরের গ্রামগুলি থেকে লোকজন আসাও কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই সারেঙ্গায় আজ আক্ষরিক অর্থেই উলটপুরাণ!
সারেঙ্গা মোড়ের কাপড় ব্যবসায়ী দিব্যেন্দু দত্ত ক্রেতাদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে খেতে বলছিলেন, “গত বছর থেকে জঙ্গলমহলের মানুষের মনে সেই ভীতি বা আতঙ্ক আর নেই। তাই চুটিয়ে পুজোর কেনাকাটা করছেন মানুষ। আমরাও লাভের মুখ দেখছি।” ব্যবসায় প্রাণ এসেছে বলে হাসি ফুটেছে সারেঙ্গা মোড়েরই রেডিমেড বস্ত্র ব্যবসায়ী শ্যামসুন্দর সেন, মেয়েদের প্রসাধনী দ্রব্যের ব্যবসায়ী শ্যামাপদ গরাই-সহ অনেকের মুখে। তাঁদের কথায়, “মাওবাদী কার্যকলাপের ওই বছরগুলোয় পুজোর মরসুমেও দোকানে মাছি তাড়াতাম। কিন্তু, গত বছর থেকে ব্যবসা জমে গেছে।” সারেঙ্গার গোয়ালডাঙার বাসিন্দা, কৃষ্ণপুর গোয়ালডাঙা সর্বোচ্চ সাধক উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ুয়া বকুল দে, পুর্ণিমা দে-রা এ বার রাইপুর থেকে পুজোর কেনাকাটা করেছে। তারা বলছে, “আগে সব সময় একটা ভয়ের পরিবেশ ছিল। পুজো এলেও বাড়ির লোক বাইরে বেরোতে দিত না। কেনাকাটাও করতে নিয়ে যেত না। খুব মন খারাপ হত। এখন পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। তাই গত বছর রাত ১২টা পর্যন্ত ঠাকুর দেখেছি। এই বছরেও দেখব।”
পুলিশ জানাচ্ছে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাঁকুড়ার সারেঙ্গা, রাইপুর, রানিবাঁধ ও সিমলাপাল ব্লকে মাওবাদী নাশকতার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলছেন, “জঙ্গলমহল এখন একেবারেই স্বাভাবিক।” খুন হওয়ার আতঙ্ক থেকে মানুষ এখন মুক্তজানাচ্ছেন খোদ সিপিএমের সারেঙ্গা জোনাল কমিটির সম্পাদক অজিত চট্টোপাধ্যায়ও।
এক সময় যে এলাকা ছিল মাওবাদী উপদ্রুত, সেই বারিকুলের ফুলকুসমা সর্বজনীন দুর্গোসব কমিটির পুজোর বাজেট এ বার ৫ লক্ষ টাকা। ওই পুজো কমিটির সম্পাদক পার্থপ্রতিম দে জানান, আগে ভয়ের পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে পুজোর সময় গ্রামবাসীদের একটা অংশ গ্রামের বাইরে চলে যেতেন। গ্রামের পুজোয় আনন্দ বলে কিছুই ছিল না। সাদামাটা পুজো হত। তিনি বলেন, “গত বছর থেকে ছবিটা পাল্টেছে। ঠাকুর দেখতে রাত দুটোতেও লোকজন মণ্ডপে আসছেন। তাই পুজোয় চমক আনতে বাজেট বাড়িয়েছি আমরাও।” মাওবাদী প্রভাবিত রানিবাঁধ ব্লকের ঝিলিমিলি দুর্গাপুজা কমিটির সম্পাদক সুনীলবরণ মণ্ডল বলেন, “মানুষের মধ্যে আর আতঙ্ক নেই। খোলা মনে পুজো হচ্ছে চারপাশে।” জেলা পরিষদের সদস্য তথা রানিবাঁধ ব্লকের যুব তৃণমূল সভাপতি চিত্তরঞ্জন মাহাতো জানান, রানিবাঁধের একাধিক পুজো কমিটি পুজোর চার দিনই রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করত। মাঝে মাওবাদী উপদ্রবের জেরে সেই সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গত বছর থেকে ফের সেই সব চালু হয়েছে।
সুনীলবাবুরাও নতুন করে তাই বুয়ান নৃত্যের মহড়া শুরু করেছেন। |