বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। উৎসবে মাতামাতির দৌড়ে পিছিয়ে নেই বাঁকুড়া শহরও। বছরের পর বছর রাঢ় বাংলার এই শহরে ক্রমশ বেড়েই চলেছে দুর্গা, কালী, মনসা, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক থেকে সন্তোষী পুজোর হিড়িক। পুজোতে চমক থাকুক না থাকুক, বিসর্জনে বেশ কয়েকটি সাউন্ডবক্স ও চোঙা বাজিয়ে রাস্তাজুড়ে মিছিল করার ক্ষেত্রে ছোট-বড় প্রায় সব পুজো কমিটিই একমত। আর এই রেষারেষিতে অনেকের প্রাণ ওষ্ঠাগত। পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার অবশ্য দাবি করেছেন, “বড় মিছিলের ক্ষেত্রে অবশ্যই পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তবে সব ক্ষেত্রে পুলিশ দেওয়ার মতো পরিকাঠামো আমাদের নেই।”
এমনিতেই পরিকল্পনাহীন এই শহরের সঙ্কীর্ণ পথে যানজট লেগেই থাকে। তা আরও পাকিয়ে ওঠে পালা-পার্বণের শোভাযাত্রার সময়ে। দিন দিন এ নিয়ে দুর্ভোগ বাড়লেও তা ঠেকাতে প্রশাসনের সক্রিয়তা দেখা যায় না বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। তাই যখন-তখন শহরের জনবহুল রাস্তা দখল করে বিভিন্ন উৎসবের শোভাযাত্রা বেরোতে দেখা যায়। বাসিন্দাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে ক’বছরের অভিজ্ঞতা। |
ধর্মীয় শোভাযাত্রার দখলে রাস্তা। অসহায় পথচারী। ছবি: অভিজিৎ সিংহ |
বিভিন্ন পুজো কমিটিগুলির মধ্যে কে কত বড় শোভাযাত্রা করতে পারে তার রেষারেষি শুরু হয়েছে। লোকজন ভারি করা থেকে শব্দের দাপাদাপি নিয়েও রেষারেষি চলছে কমিটিগুলির মধ্যে। সেই সঙ্গে কিছু শোভাযাত্রায় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় লোকজন ঢুকে পড়ে পথচারীদের সঙ্গে গণ্ডগোলও পাকায় বলে অভিযোগ। বাঁকুড়া শহরের বিশিষ্ট চিকিৎসক লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “বিসর্জনের শোভাযাত্রায় এক বার শহরের রাস্তায় জট পাকিয়ে গেলে তা খুলে ফের স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লেগে যায়। যানজটে অনেক সময় অ্যাম্বুল্যান্সও আটকে পড়ে। ওই অ্যাম্বুল্যান্সে কোনও মুর্মূষু রোগী কিংবা গর্ভবতী মহিলা থাকলে বড়সড় বিপদ পর্যন্ত হতে পারে।” তাঁর মতে, এ সব ক্ষেত্রে প্রশাসনের সক্রিয়তা দরকার।
শহরের মধ্যে এই ধরনের মিছিল বন্ধ করার দাবিতে দীর্ঘদিন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দাবি জানিয়ে আসছেন বাঁকুড়া জেলা শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবী মঞ্চের সম্পাদক তথা বাঁকুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন দরিপা। তাঁর কথায়, “মনসা পুজো থেকে সেই যে বিসর্জনের শোভাযাত্রার নামে শহরজুড়ে একটা বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, তা চলে কালীপুজো পর্যন্ত। তীব্র শব্দে সাউন্ডবক্স বাজিয়ে জনবহুল এলাকা দিয়ে মিছিলগুলি নিয়ে যাওয়া হয়। যানজটও পাকিয়ে ওঠে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য হাজার হাজার মানুষ কষ্ট পান। কিন্তু প্রশাসন নির্বিকার থাকে।”
মহকুমাশাসক (বাঁকুড়া সদর) অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ও স্বীকার করেছেন, “মাইক বা সাউন্ডবক্স বাজিয়ে শোভাযাত্রার অভিযোগ মাঝে মধ্যেই পাই। তবে বিনা অনুমতিতে মাইক বাজানো ও পুলিশের অনুমতি ছাড়া শোভাযাত্রা করা নিয়ম বিরুদ্ধ।” তিনি জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট পুজো কমিটির বিরুদ্ধে প্রশাসন যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।” |
বস্তুত দুর্গাপুজো ছাড়া বাঁকুড়া শহরে অন্য পুজোগুলি নিয়ে কোনও পরিসংখ্যান বাঁকুড়া পুলিশের কাছেও নেই। পুজো কমিটিগুলিও পুলিশের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখে না বলে পুলিশের একাংশের দাবি। তাই হুটহাট কখন কোন পুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রা শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় বেরিয়ে যানজট সৃষ্টি করতে চলেছে তার আগাম খবরও অনেক সময় থাকে না পুলিশের কাছে। জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “আগাম খবর দিলে আমরাই শোভাযাত্রার রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করতে পারি। তাতে পথচারী ও শোভাযাত্রায় থাকা মানুষজন, দু’তরফেরই সুবিধা হবে।” কিন্তু অধিকাংশ শোভাযাত্রায় তা না হওয়ায় ঢিমে তালে চলতে থাকা শোভাযাত্রার পিছনে ফেঁসে গিয়ে বেগ পেতে হয় সাধারণ মানুষকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আটকে পড়ে বহু যানবাহন। সেই জট কেটে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে আরও সময় গড়িয়ে যায়। ফলে গন্তব্যে পৌঁছতে অনেকের দেরি হয়।
জেলা পুলিশ প্রশাসনের গাফিলতিকেই এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী করছেন সাধারণ মানুষ। বাঁকুড়ার সারদামণি গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ গুপ্তের কথায়, “শহরের রাস্তা রুদ্ধ করে এই ধরনের মিছিল মানা যায় না। এমনিতেই শহরের রাস্তার পরিকাঠামোর তুলনায় যানবাহণের সংখ্যা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই রয়েছে। তার উপরে এই ধরনের উপদ্রব মানুষের পথে নামার যন্ত্রণাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে। এ সব রুখতে পুলিশকে আরও সক্রিয় হতে হবে।”
শহরের বড়বড় দুর্গাপুজো কমিটিগুলির একাংশও এই ভাবে যানজট সৃষ্টি করে ভাসানের আয়োজন করার বিরোধী। লালবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির সাধারণ সম্পাদক গৌতম দাস বলেন, “শহরের মধ্যে সাউন্ডবক্স বাজিয়ে শোভাযাত্রা করার সংস্কৃতিকে আমরা সমর্থন করি না। জনজীবন ব্যহত করে কিছু করার পক্ষপাতি আমরা নই।” তাঁর দাবি, বিনা অনুমতিতে শহরের মধ্যে বিসর্জনের শোভাযাত্রা রুখতে পুলিশ কড়া পদক্ষেপ নিক।
পুলিশ সুপার বলেন, “কয়েকটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া শহরের ভিতরের ব্যস্ততম এলাকায় ভাসানের মিছিল করার অনুমতি আমরা দিই না। সব ক্ষেত্রে পুলিশ দেওয়ার পরিকাঠামো আমাদের নেই। তাই কমিটিগুলিকেও স্বেচ্ছাসেবক নামিয়ে শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়।” তবে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, বিনা অনুমতিতে শহরের রাস্তা আটকে শোভাযাত্রা বের হলে পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নেবে।
সামনেই দুর্গাপুজো। এ বার শোভাযাত্রায় যন্ত্রণার চেনা ছবি কি বদলাবে? পরীক্ষা পুলিশের। |
রুদ্ধপথ, ক্ষুব্ধ যাত্রী |
ভাসানের শোভাযাত্রার নামে যানজট চলে
মনসাপুজো থেকে কালীপুজো পর্যন্ত।
মধুসূদন দরিপা
সাংস্কৃতিক কর্মী |
সংকীর্ণ রাস্তায় যানজটে অনেক সময়
অ্যাম্বুল্যান্সও আটকে পড়ে।
লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়
প্রবীণ চিকিৎসক |
রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
পুলিশের আরও সক্রিয়তা দরকার।
সিদ্ধার্থ গুপ্ত
কলেজ অধ্যক্ষ |
সব সময় পুলিশ দেওয়াও সম্ভব নয়। যানজট
নিয়ন্ত্রণে স্বেচ্ছাসেবকদের নামানো হয়।
মুকেশ কুমার
পুলিশ সুপার, বাঁকুড়া |
শোভাযাত্রায় মাইক বাজাতে গেলেও অনুমতি
নেওয়া দরকার। অনেকে মানেন না।
অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়
মহকুমাশাসক (বাঁকুড়া সদর) |
রাস্তায় সাউন্ডবক্স বাজিয়ে শোভাযাত্রা করার
সংস্কৃতিতে আমরা বিশ্বাসী নই।
গৌতম দাস
শহরের এক পুজো উদ্যোক্তা |
|