শনিবারের নিবন্ধ
মা আমি বাঁচতে চাই
দ্বারকার সেক্টর ১৯-এ এই তিন কামরার ফ্ল্যাটের প্রতিমা চিরকালের মতো বিসর্জন হয়ে গিয়েছে গত ২৯ ডিসেম্বর।
ষাট ছুঁইছুঁই ফ্ল্যাটের কর্তা প্রতিদিন সকাল সাড়ে ন’টায় যন্ত্রের মতো অফিসে যান, রাত ১০টা নাগাদ ফেরেন। একটি বিমান সংস্থায় লোডারের কাজ করেন তিনি। এ বাড়ির দুই ছেলে। বাড়ির কর্ত্রী প্রাণহীন পুতুলের মতো ঘরের কাজ, রান্না, পুজো করেন।
রবিবার এলে এ বাড়ির চারটি প্রাণী একসঙ্গে সিঁটিয়ে যান। ছুটির দিনের এক-একটা মুহূর্ত স্নায়ুকে বিকল করে দেয়। আবার, আবার একটা রবিবার...!
ন’মাস আগে এক রবিবারের রাতেই সিনেমা দেখে ফেরার পথে দিল্লির বাসে ছিন্নভিন্ন হয়েছিলেন এই বাড়ির ‘নির্ভয়া’।’ তার পরেরটা ইতিহাস।
দিনকয়েক আগে ফোন করেছিলাম নির্ভয়ার বাবা-র মোবাইলে। মানসিক ভাবে রক্তাক্ত দু’টি মানুষের সঙ্গে সেই ভয়াবহ স্মৃতির বিষয়ে কথা বলা নিয়ে যথেষ্ট কুণ্ঠা ছিল। প্রশ্ন হারিয়ে যাচ্ছিল। তবু পেশার তাগিদেই ফোন করলাম।
পরিচয় জানার পর শান্ত-মার্জিত গলায় উত্তরপ্রদেশীয় দেহাতি হিন্দিতে ‘বোলে বেটি’ বলে কথা শুরু করলেন ভদ্রলোক—


আমার বাড়ি ছিল উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার নেরোরা গ্রামে। চার ভাই ছিলাম আমরা। বাড়িতে সবাই খেতি করত। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শিখে চাকরি করব। বারো ক্লাসে ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দিল।
হাই স্কুল পাশ করে বাড়ির সঙ্গে এক রকম বিদ্রোহ করেই গ্রামতুতো এক দাদা-র সঙ্গে দিল্লি চলে এলাম। কাজ নিলাম ওয়াশিং মেশিন-প্রেসার কুকার তৈরির একটা কারখানায়। তিন-চার মাস পর স্ত্রীকেও নিয়ে এলাম। আর গ্রামে ফিরিনি। দিল্লিতেই ছেলেমেয়েরা জন্মাল। প্রথমে মেয়ে, তার তিন বছর পর মেজ ছেলে, আরও তিন বছর পর ছোটটা।
সবার থেকে লেখাপড়ায় চৌখশ ছিল আমার মেয়ে। ওকে ‘বেটা’ ডাকতাম। খুব ধীর-স্থির। ছবি আঁকত। গল্পের বই পড়তে ভালবাসত। আমাদের অবস্থা অতি সাধারণ ছিল। তিন ছেলেমেয়েই সরকারি স্কুলে পড়েছে। কোনও দিন টিউটর রাখতে পারিনি। তবু স্কুলে কখনও ফার্স্ট-সেকেন্ড ছাড়া হয়নি নির্ভয়া।
খুব ভাল যোগব্যায়াম করত মেয়েটা। অনেক মেডেল পেত। ক্যারাটেও জানত। (বলেই একটু থেমে স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করলেন—“লোকগুলো যখন ওকে কষ্ট দিচ্ছিল তখন আপ্রাণ লড়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একা এঁটে উঠতে পারেনি।)
ভালবাসত একান্তে থাকতে। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর পড়া শুরু হত ওর। ঘরে ঘুরে-ঘুরে পড়ত। রাত-দু’টো-তিনটের সময় উঠে দেখতাম, পড়ছে। দিনে দেরি করে ঘুম থেকে উঠত। ওর ঘরে মাটিতে গদি পাতা ছিল। তার পাশে একটা বইয়ের র‌্যাক, ল্যাপটপ। ক্লাস টেনের পরীক্ষায় অঙ্কে ৯৯ পেয়েছিল। বিজ্ঞানের সব বিষয়ে খুব ভাল ছিল।
দেহরাদূনে চার বছরের ফিজিওথেরাপি কোর্স শেষ করে ছুটিতে বাড়ি ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল—“এ বার তোমার দুঃখের দিন শেষ। তোমার বেটা চাকরি করে তোমায় মাথায় করে রাখবে।”
সোমবার ১৭ ডিসেম্বর ২০১২ দিল্লির একটা সংস্থায় ইনটার্ন হিসাবে কাজে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। বলল, একবার চাকরিতে ঢুকে গেলে প্রথম-প্রথম আর ছুটি নেওয়া যাবে না। ‘লাইফ অব পাই’ সিনেমাটা খুব ভাল হয়েছে বলে শুনেছে, তাই বন্ধুর সঙ্গে রবিবার-ই দেখে আসবে।
১৬ তারিখ বিকেলে বেরিয়ে গেল। সাড়ে আটটা নাগাদ ওর মা ওকে মোবাইলে ফোন করল। মোবাইল বন্ধ। সাড়ে দশটার পরেও যখন ফিরল না তখন প্রচণ্ড টেনশন করছিলাম আমরা সবাই। খুব রাগও হচ্ছিল। এগারোটা দশ নাগাদ হাসপাতাল থেকে ফোন, ‘আপনার মেয়ের একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাড়াতাড়ি আসুন।’ এক বন্ধুকে নিয়ে ছুটলাম। ভেবেছিলাম হয়তো গাড়ি দুর্ঘটনায় চোট পেয়েছে।
হাসপাতালে ডাক্তারবাবুরা আমাদের ওর কাছে নিয়ে গেল। একটা স্ট্রেচারে শুয়ে ছিল। গায়ে চাদর। চাদরে ভেপসে উঠেছে চাপ চাপ রক্ত। চোখ-মুখ-ঠোঁট এমন ভাবে ফেটে গিয়েছে যে মুখটা ভাল দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু পুরো হুঁশ ছিল।
আমাকে দেখে শুধু দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। আমার পায়ের নীচে মাটি ছিল না তখন। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। মাথা কাজ করছিল না। কোনও রকমে বড় ছেলের মোবাইলে ফোন করে ওর মা-কে নিয়ে আসতে বললাম। অপারেশনের পর ওর মা-র সঙ্গেই ইশারায় কথা বলত। কিন্তু সে দিন রাতে ঠিক কী ঘটেছিল তা ওকে জিজ্ঞাসা করার হিম্মত আমাদের দু’জনের কারওরই হয়নি।
মনে মনে একটা জিনিসই চেয়েছিলাম, পঙ্গু হোক, শয্যাশায়ী হোক, অন্ধ হোক, খোঁড়া হোক যে অবস্থাতেই হোক আমার মেয়েটা যেন বেঁচে থাকে। বাকিটা ওকে আমরা সাহস দিয়ে ঠিক জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারব।
(প্রৌঢ়ের কথা আটকে যায়। ফোন নিয়ে নেন পাশে থাকা নির্ভয়ার মা। সেই গলা অসম্ভব ঠান্ডা, নিস্তরঙ্গ। কথা বলতে থাকেন তিনি)
যে দিন প্রথম আদালতে ছেলেগুলোকে দেখলাম, রাগে মাথাটা ফেটে যেতে লাগল। মনে হল সোজা গুলি করে দিই বা গলা টিপে মেরে ফেলি। তার পর ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠল। কৃমিকীটের মতো ওরা, গায়ে হাত দেওয়ার প্রবৃত্তি নেই আমার।
আইন যা করার করুক। আইনের হাতেই ছেড়েছি। তা’বলে ‘নাবালক’ বলে একটা খুনি ছাড় পেয়ে যাবে! আমার মেয়েটা যতটুকু ইশারায় আর কাগজে লিখে বলেছিল তাতে জানতে পেরেছিলাম, ওই ছেলেটাই একটা লোহার রড ওর শরীরে ঢুকিয়ে ওর অন্ত্র বাইরে বার করে এনেছিল! তাকে কিনা জেলে পর্যন্ত রাখা গেল না!
নির্ভয়ার জন্য প্রতিবাদ-মিছিলে দীপিকা পাড়ুকোন, সোনু নিগম, জাভেদ আখতার।
ছুটিতে বাড়ি এসেছিল মেয়ে। রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর সকালে কয়েকটা বই কিনতে যাওয়ার কথা ছিল। যায়নি। পাঁচজন একসঙ্গে অনেক গল্প করলাম, দুপুরের খাবার খেলাম। ওর প্রিয় পনিরের তরকারি আর গুলাবজামুন তৈরি করেছিলাম।
বড় ছেলের কাছে রবিবার কিছু ছেলেমেয়ে টিউশন নিতে আসত। ও পড়াতে বসল আর আমরা মা-মেয়ে টিভি দেখতে-দেখতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিকেলে পাশের বাড়ির দু’জন আমাদের বাড়ি এল। মেয়েই চা করল। তার পর বলল বন্ধুর সঙ্গে বেরবে। বইগুলো কিনে নেবে আর সিনেমা দেখে ন’টার মধ্যে ফিরবে।
যখন প্রথম হাসপাতালে ওকে দেখলাম ঠোঁট-মুখ ফেটে গিয়েছে। চোখ বন্ধ। চোখ মেলে আমাকে দেখেই কাঁদতে লাগল। আমার বোধবুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গিয়েছিল। তখনও নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি, নিশ্চয় সামান্য অ্যাক্সিডেন্ট। তার বেশি কিছু নয়। কেমন একটা যন্ত্রের মতো বলেছিলাম, “কুছ নেহি হুয়া মেরি বচ্চি। হাম আ গয়ে হ্যায়। সব ঠিক হো জায়গা।”
ওকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেল। একজন ডাক্তার আমাদের বললেন, “আপনারা হিম্মত রাখুন। কারণ আপনার মেয়েকে এখন হিম্মত দেওয়া দরকার। ওর শরীরের সব অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁচা খুব মুশকিল।”
তার পরেও মেয়েটা বাঁচার জন্য আপ্রাণ লড়াই করেছিল। অসম্ভব মনের জোর ছিল। ইশারায় বলত, “মা, ওই লোকগুলোকে জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়া দরকার।’ বলত, “মা, আমি বাঁচতে চাই।” কখনও আমার কান্না দেখে ইশারায় বোঝাতে চাইত, ওর বেশি কষ্ট হচ্ছে না। ১৩ টা দিন আমি হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাইনি, আর ওকে একটু-একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখেছি। আমাদের জীবনের সব উৎসব শেষ করে দিয়েছে একটা রবিবার।
(টেলিফোনের ও পারে প্রৌঢ়ার গলা দমচাপা কান্নায় ডুবে যায়। আর কিচ্ছু শোনা যায় না।)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.