মুখোমুখি...
প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ
রাজা লিয়ার এবং

পত্রিকা: ২৫ সেপ্টেম্বর কী হল?
ব্রাত্য: কী হল মানে?

পত্রিকা: সুমন, ওই দিন আপনার বন্ধু ব্রাত্যর জীবনে কিছু কি হওয়ার ছিল?
সুমন: না, মানে ... ঠিক বুঝলাম না।
ব্রাত্য: ও, আমার নাট্যদলের জন্মদিন ছিল, তাই বলছেন?

পত্রিকা: সেই সঙ্গে আপনারও জন্মদিন।
সুমন: ও...তাই!

পত্রিকা: ‘সিনেমার মতো’ দেখলেন, সুমন?
সুমন: না, এখনও দেখা হয়নি। সুযোগ পেলেই দেখব। তবে এর পিছনে কিন্তু কোনও ...

পত্রিকা: অভিসন্ধি নেই। আপনি সুমনের ‘কাঙাল মালসাট’ দেখলেন, ব্রাত্য?
ব্রাত্য: না। দেখা হয়নি।

পত্রিকা: আর তো এখন ডিভিডি ছাড়া উপায়ও নেই।
ব্রাত্য: তাই-ই দেখব।

পত্রিকা: হলে গিয়ে দেখাটা এড়িয়ে গেলেন নাকি?
ব্রাত্য: না না না, কখনও না। আমি তো আমার অভিনীত ছবিও অনেক সময় দেখি না। তার বেলায় তো বলেন না!

পত্রিকা: ২৭ মে’র পর আপনাদের বসা কি এই প্রথম?
ব্রাত্য: কেন? সেদিন কী হয়েছিল?

পত্রিকা: আনন্দবাজারে আপনার একটি সাক্ষাৎকারের পরে সুমনের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়, মনে পড়ে? অভিযোগ, ‘রাজা লিয়ার’-এর প্রদর্শন নিয়ে কিছু অসুবিধে। তাতে চিঠিচাপাটি। অভিযোগ, পালটা অভিযোগ। তার পর কি আপনাদের এই প্রথম ...
সুমন: না, তার মধ্যে সত্যিই আমাদের কোনও কথা হয়নি।
ব্রাত্য: না, না, না, হয়েছে। ফোনেও কথা হয়েছে।

পত্রিকা: দেবশঙ্কর, পুরো ওই এপিসোডটার বাইরে দাঁড়িয়ে আপনার কী মনে হচ্ছিল? অসহায়? বিরক্তি? নাকি ওটাই অনিবার্য ভেবে দুঃখ পাওয়া?
দেবশঙ্কর: না, কাগজের লোকেদের খবর দরকার থাকে। সেখানে কিছু মতামত জানতে চাওয়া হয়। অনেকেই তাতে মতামত দেন। এক্ষেত্রে তার জন্যই থিয়েটারের বাইরের লোকজন কিছু মতবিনিময় জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু আমরা যাঁরা ভিতরে থাকি তাঁরা জানি, ঝগড়াবিবাদ যেমন আছে, তেমন তারিফ করাটাও আছে। আমার বিশ্বাস, আজ যাঁরা এসবে জড়াচ্ছেন, কালই তাঁরা একসঙ্গে কাজ করবেন।

পত্রিকা: ব্রাত্য, ‘রাজা লিয়ার’ আমরা আবার কবে দেখতে পাব?
ব্রাত্য: মিনার্ভা রেপারটরির আগেকার অভিনেতাদের চুক্তি ফুরিয়েছে। নতুনদের নেওয়া হচ্ছে। পুরনোও থাকছে। এদের নিয়ে করতে চাইলে...
সুমন: দেখুন, যখন নাটকটা চলছিল একটা গতিতে, তখন যদি কথা বলার অবকাশ ঘটত, পুরনোদের নিয়ে সেটা হয়তো সম্ভব ছিল। কিন্তু সে আলোচনার অবকাশ হয়নি।

পত্রিকা: হয়নি কেন?
সুমন: সেটা আমি বলতে পারব না।

পত্রিকা: মিনার্ভা ছাড়া অন্য হলেও তো করার কথা ছিল। একটা বা দুটোর পর তা’ও আর হল না।
সুমন: কখনও হয়তো শো করার কথা হয়েছে। ডেট-এ মেলেনি। অনেক সময় হয়তো ব্যাপারটাকে আলগা ভাবে দেখা হয়েছে। তার পিছনে কতটা রাজনীতি ছিল, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিল, কতটা পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব ছিল বলতে পারব না। আমার শুধু মনে হয়, আরও কিছু অভিনয় পুরনো অভিনেতাদের দিয়ে হতে পারত। সম্প্রতি একটা চিঠিও নাকি মিনার্ভা রেপারটরি থেকে আসবে, বলেছে ব্রাত্য, সে চিঠি আমি এখনও হাতে পাইনি, সে সব পেলে তখন দেখা যাবে।

আড্ডার আগে সুমন, দেবশঙ্কর, ব্রাত্য
এক হাজার রজনী vs ইউজ অ্যান্ড থ্রো

পত্রিকা: থিয়েটার কিন্তু এখন বেশ হাউস ফুল হচ্ছে। টিকিটের দাম দুশো থেকে এক হাজার টাকা হলেও উৎসাহ কমছে না...
সুমন: না, সব নাটক যে সমান ভাবে দর্শক পাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। তবে ২০০০-এর পর থেকেই ট্রেন্ডটা এমন। এর আগে ’৭৭-এ ‘জগন্নাথ’, ’৮৮-এ ‘মাধবমালঞ্চি কইন্যা’ আর ‘শেষ সাক্ষাৎকার’ হিট। মাঝে দশ বছরের গ্যাপ। হিট নেই। এর ঠিক পরে ’৯১-এ ‘দায়বদ্ধ’ আছে। তার পর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’-এ এসে একটা বড় পরিবর্তন এল। কিন্তু আমার প্রশ্ন, থিয়েটারের পরিমাণগত উন্নতিটা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু গুণগত মান কি বেড়েছে?
দেবশঙ্কর: ‘নাথবতী অনাথবৎ’ যখন শাঁওলি মিত্র করছেন, তখনও কিন্তু প্রচুর টাকা দামের টিকিট বিক্রি হত এবং বেশ তাড়াতাড়িই হত। তখন এক-একটা নাটক বেশ হিট হচ্ছিল, অন্যগুলোয় হয়তো মালমশলা থাকা সত্ত্বেও লোক টানতে পারছিল না। ২০০০-এ এসে খেলাটা ঘুরল। কিন্তু আগেও মাঝে মাঝে এক-একটা বিচ্ছুরণ কিন্তু ঘটত। কোনও দলের একটা নাটক হিট হলে তার পরের নাটকে তার ছাপটা পড়ত। ওই যেমন সায়ক-এর ‘দায়বদ্ধ’র পরের নাটক ‘বাসভূমি’।
সুমন: আর একটা ব্যাপার, ’৯৫-’৯৬ পর্যন্ত একটা বিশেষ শ্রেণির দর্শক থিয়েটার দেখছিল। ২০০০ সাল থেকে থিয়েটারের দর্শকে নতুন প্রজন্মও যোগ হয়েছে।

পত্রিকা: আপনার ব্যাখ্যাটাও কি একই রকম ব্রাত্য?
ব্রাত্য: আপনি যে বহুল দেখা নাটক বলছেন, তাতে গণমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা আছে। যেটা এই সময়কার একটা সিগনেচার। সেই হাইপটা যখন থিতিয়ে যায়, তার পরেও যদি থিয়েটারটা চলে, অর্থাৎ ২০০২-এ ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ হয়েছে, সেটা এখন হলে চলবে কি? যদি চলে তো বুঝতে হবে তার একটা কোনও জোর আছে। অর্থাৎ বিষয়টাকে পঁচিশ-তিরিশটা শো-এর লিগে আমি দেখতে চাই না। তার পর তথাকথিত জনপ্রিয় নাটক, সুমনের কথাটা ধরেই বলছি, ২০০০ পরবর্তী সেই সব নাটক ক’টা চলেছে? ’৭০-’৮০ দশকের যে নাটকগুলোর কথা বলা হল, সেগুলোর অনেকগুলোই হাজার রজনী অতিক্রম করেছে। এখন তো পরিস্থিতিটাই পালটে গেছে। এই সময়ে এক হাজার নাইট করা সম্ভব নয়। থিয়েটার হয়ে গেছে, ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’র মতো।

পত্রিকা: যাঁদের থিয়েটার বা অভিনয় বা পরিচালনা এই মুহূর্তে বেশি আলোচিত, তাঁদের পরিণত হয়ে ওঠাটাও কি দর্শক পাওয়ার অন্যতম কারণ? ব্রাত্যর কথাই যদি ধরি, প্রথম নাটক ‘অশালীন’ লেখার সময় ওঁর বয়স পঁচিশ। নাটকটি মঞ্চে আসছে যখন, তখন উনি ছাব্বিশ। আজ ব্রাত্য কুড়িটিরও ওপর থিয়েটার মঞ্চায়নের অন্যতম কারিগর...
দেবশঙ্কর: না দেখুন, ব্রাত্য অল্প বয়েসে যে টেক্সট লিখেছে বা কম বয়েসে সুমন যে কাজ করেছে, সেটা এখনও সুস্বাদু, পরিপক্ক, পুষ্টিকর বলেই মনে হয়। অভিজ্ঞতার মিশেল ঘটলেই একজন একটা পপুলার থিয়েটার দিতে পারবেন, তা কিন্তু নয়।
সুমন: বিষয়টিকে সামাজিক ভাবে দেখা উচিত। সিনেমাতে কী ছিল, পাঁচ বছর ধরে ‘শোলে’ চলেছে, এখন রিলিজ করলে সেটা হবে নাকি! এখন ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’-এর মতো ছবি এক মাসের মধ্যে উঠে যায়। সময়টা পালটেছে। লোকের দেখার ভঙ্গি পালটেছে। কিন্তু, থিয়েটার সেটা ধরতে পারছে কি?


দলতন্ত্র

পত্রিকা: থিয়েটারের নতুন একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে, বহু দলে ছড়িয়ে কাজ করা, দেবশঙ্কর হালদার যার পায়োনিয়ার, ‘নান্দীকার’-এর মতো সেন্ট্রালাইজড দলে থেকেও অন্য দলের নাটকে মূল চরিত্রে তিনি...
সুমন: এটাকে ভীষণই ওয়েলকাম করি। কিন্তু শুধুমাত্র অভিনেতা চালাচালি করলেই তো হয় না। পরিকাঠামোর সমস্যাটা তো রয়েই গেছে...এখন কোনও নির্দেশক ৫০টা লোক নিয়ে কোনও থিয়েটার করতে পারবে না। ছোট ছোট দল নিয়ে বেশির ভাগ নাটক হচ্ছে। সবাইকে অনেক দিন রাখা যাচ্ছে না। এসব ওই পরিকাঠামোরই জন্য।

পত্রিকা: অনেক চরিত্র নিয়েও তো থিয়েটার কম হচ্ছে না, ‘নাচনী’, ‘অয়দিপাউস’, ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’...
সুমন: না, চল্লিশটা লোক দেখলে শুধু হবে না, জিনিসটা তৈরি হচ্ছে কী করে? সেই প্রসেসটা কি নিতে পারব, যেটা ‘তিস্তাপারের...’ সময় নিয়েছি? ৭০টা লোক নিয়ে ওয়ার্কশপ করেছি দিনের পর দিন। তারপর দেখুন, আমাদের কল শো করার রীতি। এই তো শো করলাম ‘কলামন্দির’-এ, তার আগে একটা ব্যান্ডের গান ছিল। তখন ভাবুন, নাটক শুরু হবার আগে প্রস্তুতির চেহারাটা। শনিবার-রোববার যদি একাডেমিতে কেউ নাটক করতে যায়, কী ভাবে সেট করা হয়, কী ভাবে লাইট ডিজাইনার লাইট করেন ... এটা যদি দেখেন। ... এখানে আমরা কঠোর ভাবে বলতে পারিনি, এ ভাবে নাটক করবেন না। সিপিএম-এর আমলে নেতারা বক্তৃতা দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে যেতেন, তার পর নাটক হত। ভাবখানা এমন যেন, এবার আপনারা চট-টট টাঙিয়ে যা-তা করুন। একমাত্র শম্ভু মিত্র শুধু বলেছিলেন, পরের দিন শো করতে গেলে, আগের দিন আমার লোক যাবে, গিয়ে দেখে আসবে, তার পর টিম যাবে। বেসিক এই জায়গাগুলো আমরা ছেড়ে দিয়ে গেছি।

পত্রিকা: তাই কি ব্রাত্য?
ব্রাত্য: দেখুন, আমার আগে কোনও অনুষ্ঠান থাকলে কল শো-তে থিয়েটার করি না। আর একাডেমির শনি-রবিতে সমস্যাটা বহু পুরনো সিনড্রোম। বরং যেটা দেবশঙ্করের বিভিন্ন গ্রুপে কাজ করার উদাহরণ আপনি দিলেন, তার প্রেক্ষিতে বলব, আগে ভিসা দানের প্রক্রিয়া ছিল না, কাঁটাতারের যে বেড়া ছিল, সেটা যে ভেঙে গেছে, থিয়েটারের অস্তিত্বের স্বার্থের কারণেই ভেঙে গেছে। দলের মধ্যে শিথিলতা তৈরি হয়েছে। এক সময় দল ভাঙত, এখন উলটোও হচ্ছে। ‘ব্রাত্যজন’ যেমন, বিভিন্ন জায়গায় পাঁচটা-ছ’টা ব্রাত্যজন তৈরি হয়েছে।

যদিও স্বপ্ন

ব্রাত্য: আমার একটা অন্য কথা মনে হয়। সত্যিই খুব ভাল হত, যদি চার-পাঁচটা দল মিলে একটা ভাল অডিটোরিয়াম করা যেত। এক সময় সে চেষ্টাও করেছিলাম আমরা। শেষ অবধি জানেন, স্কিলটা ম্যাটার করে। আর সেখানে ‘সেন্স অব ইনডিভিজুয়ালিটি’ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জায়গাটা থাকবেই। এই স্বাতন্ত্র্যবোধের সঙ্গে কমিউনিটি ফিলিং-এর সংঘাত বরাবরই ছিল। এখন সেই সংঘাতটা স্পষ্ট হচ্ছে, ব্যক্তির নামে দল হচ্ছে। এ বার এই স্বার্থের কারণেই যদি একটা নতুন জায়গা তৈরি করতে পারতাম ....
সুমন: পরিকাঠামো নিয়ে আমার একটা অন্য কথা মাথায় ঘোরে। আমরা কতগুলো বদল করতে পেরেছি, যেমন সকালবেলার শো আবার চালু হয়েছে। কিংবা দলের মধ্যে অভিনতাদের চালাচালিটা হচ্ছে। কিন্তু ধরুন, ব্রাত্য বলল, আমি এমন একটা নাটক করতে চাই যেটা যেখানে তৈরি হবে, সেখানেই অভিনীত হবে। টানা দশটা শো করব। তার পর দেখব আবার দশটা শো করা যায় কিনা। এ ভাবে সরকারি হলে একটা আবেদন করলাম, টানা পনেরো দিন ডেট দিন। পাঁচদিন রিহার্সাল। দশ দিন শো। এই পনেরো দিন টানা তারিখ কিন্তু পাওয়া যাবে না। কেননা সরকারি নিয়মে এটা বাধে। কারণ সরকারের একটা হলে একবারের বেশি মাসে ডেট পাবেন না।
ব্রাত্য: হ্যাঁ, এটা সরকারি জায়গায় সম্ভব নয়। কিন্তু অন্য কোথাও একটা জায়গায় তো করতে পারি। আর সরকারি হলে করলে সেটাও তো সরকারের অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করতে হয়।
দেবশঙ্কর: কিন্তু কে বাছাই করবে, কোন দল বা ব্যক্তি ওই টানা পনেরো দিন হল পাওয়ার যোগ্য?
সুমন: আমি, ব্রাত্য আর কৌশিক তিনজনে একবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কাছে চেয়েছিলাম, যাতে মিনার্ভাটাকে আমাদের তিন জনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এক বছরের জন্য। তখন উনি মুখ্যমন্ত্রী। যা ভাড়া হয় আমরা দেব। দেননি। তখন ওই একই প্রশ্ন উঠেছিল, এই তিনজনকে দেওয়া হবে কেন? সুতরাং গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় এই ইনডিভিজুয়াল এক্সিলেন্সের কোনও জায়গা নেই। এটাই তো পরিকাঠামোর প্রধান প্রশ্ন।
দেবশঙ্কর: এই ঘটনাটা ঘটলে কিন্তু দারুণ হয়। কোনও বাধাবিঘ্ন ছাড়া থিয়েটারটা তৈরি করতে পারছি, সেটা যে কী অপরিসীম স্বাধীনতা!
সুমন: অন্যান্য সরকারি হলে যেভাবে বণ্টন হয় হোক না, একটা-দুটোতে তো এই স্পেসটা রাখা যেতেই পারে।

পত্রিকা: এটা সম্ভব ব্রাত্য?
ব্রাত্য: প্র্যাকটিসটা কিন্তু আমরা নিজের ভেতর থেকেও নিজেরা কখনও করিনি। এই যে দেবশঙ্করের প্রথম দলের বাইরে এসে কাজ করা, এর প্রাক্ শর্তগুলো কী ছিল? খেয়াল করবেন, যখনই দুটো বড় মানুষ একসঙ্গে একটা দলে এসেছেন, তখনই তাঁরা একটা সময় বিভক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ দলে যে মুহূর্তে দ্বিতীয় গুণী আবির্ভূত হচ্ছেন, সেই মুহূর্তে সেই দলটি ভেঙে যাচ্ছে। আমি আমার দলে যখন দ্বিতীয় কোনও গুণী হিসেবে চিহ্নিত করছি, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্তরে করছি... গণতান্ত্রিক হবার দায় কিন্তু কেবল মাত্র সরকারের নয়। দলগুলোর ধাঁচার মধ্যে কি সেই গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস হয়েছে? সত্যিকারের গুণী কে, সেটা কি দল থেকেও চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া কখনও হয়েছে? হয়নি।

ওঁরা এবং আমরা

পত্রিকা: ষাট-সত্তর-আশিতে বাংলার গ্রুপ থিয়েটারে যাঁরা রাজ করেছেন, ওঁদের সঙ্গে আপনাদের ফারাকগুলো ঠিক কোথায়?
ব্রাত্য: এক ধরনের পরম্পরা বাহিত হওয়া অর্থাৎ, আমরা যদি বাংলা থিয়েটারের প্রধান তিন পুরুষকে দেখি, শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত-অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়... ’৫২, ’৫৪, ’৬০ ... বারো বছরের গ্যাপে ব্যাপারটা ঘটছে... তার পরবর্তী কালে যাঁরাই এসেছেন, এই তিনটে সূত্র ধরেই তাঁদের পরিচিতি তৈরি হয়েছে। পরবর্তী কালে তাঁদের নাটকই বেশি দেখেছে। ধরা যাক, বহুরূপী থেকে কেউ বেরিয়ে গেছেন বা নান্দীকার বা পিএলটি থেকে কেউ বেরিয়ে গেছেন, ওঁরাও ছিলেন এক ধরনের পরম্পরা। এক ধরনের কৌলীন্যপ্রথার জন্ম হয়েছিল। তাঁরা নিশ্চয়ই বিরাট কাজ করেছেন। কিন্তু কতগুলো দলের মধ্যে সেগুলো সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সব থেকে বড় ডিপারচার এটা যে, একেবারে একটা নতুন দল, যার সেই অর্থে কোনও কৌলীন্য নেই। তারা দুম করে একটা প্রোডাকশন করছে। লোকে দেখছে। আর দুই, নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেশে যে উদারনীতিবাদ শুরু হয়, তাতে এক ধরনের পোস্ট কলোনিয়াল মধ্যবিত্ত উঠে এল। যে কি না তার জলবায়ু থেকে কথা বলতে চাইল, নিজের সময়ের উত্তাপকে ধরতে চাইল। গ্রিক, জার্মান, রাশিয়ান কোনও ঘটনা তার সঙ্গে এখানকার একটা সন্নিধি তৈরি করে, একটা বার্তা দেওয়ার প্রবণতার চেয়ে, অনেক সরাসরি বলার চেষ্টা করল। এইটা এক ধরনের ডিপারচার।
সুমন: আমার কাছে ডিপারচারের আরও কতগুলো দিক এসেছে। যেমন থিয়েটার যে নতুন বয়ানে কথা বলতে শুরু করল, অভিনতাদের যে একটা ভয়ংকর বদল হল, দেবশঙ্কর এল, গৌতম, সুরজিৎ এল। তাতে একটা অভিনয়ের ঘরানার বদল ঘটল। মঞ্চসজ্জার ক্ষেত্রেও এই ডিপারচার ঘটেছে। সঞ্চয়ন ঘোষ নিশ্চয়ই তার একটা ধারণা তৈরি করে। হিরণ মিত্র তাতে অনেকটাই যোগ করেছে।
দেবশঙ্কর: টেকলোলজির ব্যবহারেও বদল এসেছে। শব্দের জন্য যে যন্ত্রটাকে এখন আমরা ভাড়া করি, সেটা আগের চেয়ে উন্নত। সেটও তাই...
ব্রাত্য: ‘সেন্স অব ভিস্যুয়াল’ও দিন দিন বদলাচ্ছে। এমন এমন গ্যাজেটস আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটাই যখন থিয়েটারে রূপান্তরিত হচ্ছে ...

সমকাল না মহাকাল

পত্রিকা: থিয়েটারে সমকালের কথা যদি বলেন, ইস্যুটাকে শুধু লোকাল নয়, গ্লোবালিও যদি দেখি... আগেকার থিয়েটারে এ ধরনের প্রতিফলন যেভাবে পড়ত, এখন বাংলার থিয়েটারে ততটা হয় না, এটাও কি একটা ডিপারচার হিসেবে দেখব?
দেবশঙ্কর: আমি মনে করি থিয়েটার একান্তভাবেই লোকাল এবং দেশীয় ... এটা ক্রিকেট খেলা নয়... যদি হাউস ফুল হয়, এটা ৭২৩ জনের খেলা। লোকে দেখবে, ভাল লাগলে ‘দাদা ভাল হয়েছে’ বলে টাটা করবে। আমি ট্যাক্সি বা গাড়ি করে বাড়ি ফিরব। একে ভাবনার দীনতা বলে মনে করতে পারেন কেউ, কিন্তু এটা এমনই। বরং এখানে জোর করে গ্লোবাল কিছু ঢোকালে কনফিউশন বাড়বে। যেটা আগে হত অনেক সময়ই।
সুমন: এটা সত্যি, আগে থিয়েটারে প্রকট ভাবে রাজনীতি ছিল, এখন সেটা নেই। এটা একটা সময় হয়েছিল। একটা অকারণ রাজনৈতিক প্রকটতা আমাদের মঞ্চে ঢুকে পড়েছিল। ইমিডিয়েটলি বলতে হবে, কমেন্ট করতে হবে। স্লোগান দিতে হবে। আমরা সেটার থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছি। সব সময় তার দরকারও নেই। কিন্তু যখন দরকার পড়েছে, ‘মেফিস্টো’ হয়েছে। গুজরাত দাঙ্গার বিরুদ্ধে। সাত দিনের মধ্যে নাটক নেমেছে। আবার যৌনতা নিয়েও আমরা নাটকে কথা বলেছি। সময়ের দাবিতে।

পত্রিকা: কিন্তু কেউ যদি বলেন, এই সময়ে দাঁড়িয়ে অন্তত পার্ক স্ট্রিট বা কামদুনির ঘটনা উল্লেখ করবেন না? সেই দায় কি আপনার নেই?
সুমন: দায় আছে। কিন্তু দাদন দিয়ে করতেই হবে বলছি না।
দেবশঙ্কর: অবিচার, মহিলা, ধর্ষণ, ঘৃণ্য ইত্যাদি বোধ মাথায় রেখে আমি যখন ‘অয়দিপাউস’ করি, যেখানে ধর্ষণ করা চলছে, এরকম একটা দৃশ্যে আমি সংলাপ বলি, ‘দেবতারও ভুল হয়ে যায়। মানুষের পাপ অতিক্রম করে যাবে পাপের ধারণা’। এই যে দিল্লির মেয়েটিকে এ ভাবে মারা হল, আমি যখন অভিনয় করি অন্তত ভাববার চেষ্টা করি, বলবার চেষ্টা করি। কতটা সরাসরি হয় জানি না। করি।
সুমন: আসলে সময়ের প্রতিফলনটা থাকে। নাটক বাছার মধ্যেও প্রতিফলন থাকে। যখন ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’ করেছি, সেটা গণধর্ষণের ঘটনা নিয়েই ছিল। কিন্তু এক্ষুনি, এখনই শিল্পীকে নেমে পড়তে হবে এই ব্যাপারটা ঠিক আমার মনে হয় না।
দেবশঙ্কর: ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এ কিছু সংলাপ যেমন, যেটা ওখানে বলাই যায় না, সময়কে ধরতেই ব্যবহার করা হয়েছে।
সুমন: আসলে এগুলো বলার সময় ভেতরে ভেতরে সমকালটা কাজ করে। একটা পুরাকালের নাটক, প্রেক্ষাপটটা হয়তো সমকালীন নয়। কিন্তু সমকালীন সত্যকে সে ছুঁতে পারছে, সেটা আমার কাছে অনেক বেশি সমকালীন। কিন্তু প্রেক্ষাপটে সমকালীন, কতগুলো গ্যাদগ্যাদে কথায় ঠাসা, তার কোনও বৃহত্তর প্রেক্ষিত নেই, সেটা আমার কাছে সমকালীন নয় কিন্তু। আমি ‘মেফিস্টো’ করার কথা ভাবছি, কারণ আমার মনে হচ্ছে, শিল্পীর পক্ষ নেওয়ার সময় এসেছে।
ব্রাত্য: সমকালের জলবায়ুতে আটকে না থেকে যখন তার ‘বিয়ন্ড’টাকে থিয়েটার ছুঁতে পারে, তখন সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা সমকাল নিয়ে হতে পারে, আবার মহাকাল নিয়েও হতে পারে।
সুমন: ব্রাত্য, একটা কথা বলব, থিয়েটারে থেকে ইদানীং আমার ‘আনইস্পায়ার্ড’ লাগে। থিয়েটারে পার্টটাইমই রয়ে গেলাম। সেটা গোটা ভারতের প্রেক্ষিতেই বলব। পশ্চিমবঙ্গে তো আরও বেশি করে। এত দিন ধরে একটা বামজমানা চলল, অথচ একটা পৃথ্বী থিয়েটারও বানানো গেল না! ব্যাপারটা শুধু দুঃখের নয়, হতাশারও।
ব্রাত্য: এটা একদিন হবেই, এটা আমার বিশ্বাস...

শ্যুটিং স্পট: ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.