|
|
|
|
কংগ্রেস কি বন্ধু, সংশয় কাটাতে বৈঠক ৬ই
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
আবার সেই পুরনো বিতর্ক। কে বড় শত্রু, কংগ্রেস না বিজেপি? এবং লোকসভা ভোটের কয়েক মাস আগে এই প্রশ্নের জবাব এখনও স্পষ্ট নয় সিপিএমের কাছে।
পাঁচ বছর আগে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে মনমোহন সিংহের সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল সিপিএম। তখনও কিন্তু একই বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম নেতারা পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করলেও ইউপিএ-র সঙ্গ ছাড়তে রাজি ছিলেন না। রাজি ছিলেন না মনমোহনের সরকারকে ফেলে দিতে। শেষ পর্যন্ত বাইরে থেকে সমর্থন দেন মুলায়ম সিংহ। সরকার বেঁচে যায়।
এখন অবশ্য পটভূমি বদলে গিয়েছে। এক দিকে, মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, নীতি পঙ্গুত্ব কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। প্রায় দশ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে যে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়ায় উঠেছে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, তাকে আরও উস্কে দিয়েছে এই অভিযোগগুলি। অন্য দিকে, মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির উত্থান। দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হওয়ার পরে মোদীর সভায় উপচে পড়ছে ভিড়। তিনি নিজেও চাইছেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর যে উন্নয়নমুখী ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তাকেই গোটা দেশে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু ২০০২ সালের গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গার ছায়া এখনও তাঁর পিছু ছাড়েনি।
এই পরিস্থিতিতে সিপিএম কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সামনে বড় প্রশ্ন: কংগ্রেস বিরোধিতা? নাকি নরেন্দ্র মোদীকে রুখতে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একজোট করার লক্ষ্যে কংগ্রেসের পাশে থাকা?
আগামী ৬ অক্টোবর দিল্লিতে পলিটব্যুরো বৈঠকে এই পথ-নির্দেশিকা তৈরি করা নিয়ে দলের মধ্যে বিতর্কের ঝড় উঠতে পারে। তার পরে ৩০ অক্টোবর তালকাটোরা স্টেডিয়ামে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সম্মেলনের আয়োজন করেছে সিপিএম। এই সম্মেলনে অ-কংগ্রেসি ও অ-বিজেপি প্রায় সব দলকে একত্রিত করার ডাক দেওয়া হয়েছে। মুলায়ম সিংহ এর মধ্যেই প্রকাশ কারাটকে আশ্বস্ত করেছেন, উত্তরপ্রদেশ থেকে সপা নেতা-সমর্থকদের একটি বড় অংশ ওই সভায় উপস্থিত থাকবে। সিপিএম নেতারা জানেন, নিজস্ব শক্তিতে তালকাটোরা স্টেডিয়াম ভরানো দলের পক্ষে বেশ কঠিন কাজ।
এই সম্মেলনে কিন্তু এখনও কংগ্রেসকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এবং তাই নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে সিপিএমের অন্দরমহলে। প্রশ্ন উঠেছে, যদি ধর্মনিরপক্ষে শক্তিকে একজোট করার লক্ষ্যে এই সম্মেলনের আয়োজন হয়ে থাকে, তা হলে সেই তালিকা থেকে কংগ্রেস বাদ কেন?
দলের নিচুতলায় এ নিয়ে সংশয় থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সমস্যা হল, শীর্ষ স্তরেও এই ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ মনোভাবের প্রকাশ ঘটছে বারবার। এমনকী, দলের কাণ্ডারী প্রকাশ কারাটের সাম্প্রতিক বেশ কিছু বিবৃতিতেও রাজ্য নেতারা স্ববিরোধ খুঁজে পেয়েছেন। সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিকের আড্ডায় গিয়ে কারাট তীব্র কংগ্রেস-বিরোধিতার কথা বলেন। তার কিছু দিন পরে একটি অর্থনৈতিক সংবাদপত্রে কংগ্রেসের পক্ষে যুক্তি দেন। তার পর আবার এক জাতীয় দৈনিকে কংগ্রেসের বিরোধিতায় সরব হন। ফলে কারাট নিজে আসলে কী চাইছেন, তা এ বারের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে স্পষ্ট ভাবে জানতে চাইবেন রাজ্য নেতৃত্ব।
যে তিনটি রাজ্য সিপিএমের মূল শক্তি হিসেবে পরিচিত, সেই কেরল, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মধ্যে প্রথমটিতে তাদের লড়াই সরাসরি কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই। সেখানে অর্থাৎ কারাটের রাজ্যে আসন বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে সিপিএমের। ত্রিপুরায় লোকসভা আসন মাত্র দু’টি। সেখানেও মূল প্রতিপক্ষ কংগ্রেস। তবে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-বিরোধিতাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ অবস্থায় শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তি করতে রাজি নন সিপিএমের রাজ্য নেতারাও।
কংগ্রেস ও বিজেপি, কে বড় শত্রু এই বিতর্ক অবশ্য দীর্ঘদিনের। ১৯৮৯ সালে কংগ্রেস-বিরোধিতা করে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের পাশে দাঁড়িয়েছিল সিপিএম। ভিপি-র সঙ্গী ছিল বিজেপিও। তারও আগে সিপিএম এবং সিপিআইয়ের মধ্যেও কংগ্রেস সম্পর্কে দলীয় অবস্থান নিয়ে মতপার্থক্য কম হয়নি। সিপিএমেও একটা সময় ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ এবং হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের মধ্যে এ বিষয়ে অবস্থানগত ফারাক ছিল। সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে সুরজিৎই দলকে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়াতে বলেছিলেন। দিল্লি পার্টি কংগ্রেসে যখন সুরজিতের কাছ থেকে প্রকাশ কারাট দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, সে বারের দলিলেও বলা হয়েছিল তৃতীয় বিকল্প গড়াই দলের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য। কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখতে ধর্মনিরপেক্ষ জোট গঠনে কংগ্রেসের সঙ্গে থাকাটাও জরুরি। অন্ধ্রপ্রদেশে হওয়া বর্ধিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেও এ বিষয়ে বিতর্ক হয়েছিল। আগের লোকসভা ভোটে তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ধুলিসাৎ হয়ে যায়। তখন সীতারাম ইয়েচুরির মতো নেতারা জোড়াতালি দিয়ে এই ধরনের ফ্রন্ট গঠন করার চেয়ে বিজেপিকে রুখতে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়ে ধর্মনিরপেক্ষ জোটকে শক্তিশালী করার পক্ষে সওয়াল করেন। ওই অংশের যুক্তি, বাম যখন সেই পরিসর দখল করতে পারছে না, তখন কংগ্রেসকে দুর্বল করলে লোকসানই বেশি।
সেই বিতর্ক ফিরে এসেছে। লোকসভা ভোটের আগে পলিটব্যুরোর বৈঠকে দলকে এ ব্যাপারে অভিমুখ স্পষ্ট করতে হবে। |
|
|
|
|
|