কল্যাণগড় স্কুলের পাশ দিয়ে ইটপাতা রাস্তায় নামার পরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। তাকে ছাপিয়ে কানে আসে সেলাই মেশিনের শব্দ। অথচ, কয়েক বছর আগেও অশোকনগরের নট্টপাড়ায় পুজোর আগে শোনা যেত ঢাক-ঢোলের আওয়াজ। বিশেষত ঢোলবাদনে নট্টপাড়া ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গুপির সঙ্গী বাঘা বায়েনের ঢোলের বোল তো তুলেছিলেন নট্টপাড়ার ঢুলিই!
দেশভাগের সময় পেশায় চামড়া দিয়ে বাদ্যযন্ত্র প্রস্তুতকারী নট্টরা বরিশাল থেকে চলে এসেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের কল্যাণগড় এলাকায়। দেশভাগের যন্ত্রণা ঢাকা পড়ে ঢোলের বোলে। তাঁদেরই একজন ক্ষীরোদ নট্ট। ভক্তেরা তাঁকে ডাকতেন ‘ঢোলের রাজা’ বলে। ১৯৬৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’ ছবিতে ‘দেখো রে নয়ন মেলে’, ‘ভূতের রাজা দিল বর’ মতো গানের সঙ্গে তাঁর ঢোলের বোল বাঙালিকে মাতিয়ে দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানিত করেছিল ক্ষীরোদবাবুকে। |
অশোকনগরের কল্যাণগড় এলাকার নট্টপাড়া। |
বাঘার ঢোল যাঁর হাতে বেজেছিল তাঁর বাড়িতে এখন একটাও ঢোল নেই। তাঁর পরিবারের কেউ এখন ঢোল বাজায় না। ক্ষীরোদবাবুর মৃত্যুর পর তাঁর ঢোলটিও নিয়ে গিয়েছে কলকাতা জাদুঘর। গোটা নট্টপাড়াতেই ঢুলি নেই বললেই চলে। শুধু তাই নয়, এই পাড়ার অনেকে আদালতে গিয়ে বদলে ফেলেছেন নট্ট পদবিটাও।
ক্ষীরোদবাবুর স্মৃতিটাই এখন নট্টপাড়ার সম্বল। ক্ষীরোদবাবুর ছেলের বউ গীতা নট্ট বলেন, “আমার শ্বশুরমশাই ভোর চারটেয় উঠে ঢোল নিয়ে রেওয়াজ শুরু করতেন। বয়স বাড়লেও রেওয়াজ বন্ধ করেননি।” ঢোল বাজিয়ে সংসার চলে না, তাই নট্টপাড়ার অন্য পরিবারগুলির মতো তাঁদের পরিবারেও কেউ আর ঢোল বাজায় না। নট্ট পাড়ায় এখন প্রায় ৫০ ঘর নট্ট বাস করেন। তাঁদের কেউ পুরোনো জামাকাপড় ফেরি করেন, কেউ বিড়ি বাঁধেন, কেউ বা ছোটখাটো চাকরি করেন। তিন-চার জন পুজোর সময় বাইরে ঢাক বাজান। তবে ঢোলের ব্যবহার হয় না বললেই চলে।
ক্ষীরোদ নট্টের প্রপৌত্র জিৎ নট্টের কথায়, “নট্ট সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। নট্ট পাড়ার কিছু বাড়িতে এখন তাসা, কুড়কুড়ি প্রভৃতি আধুনিক বাজনার উপকরণ থাকলেও ঢোল পাওয়া যায় না।” জিতের ক্ষোভ, “পাড়ার অনেকে নট্ট পদবিটাও আদালতে গিয়ে বদলে নিচ্ছে। এই পদবি নিয়ে চলতে তাঁরা হয়ত সঙ্কোচ বোধ করছেন।” |
ক্ষীরোদবাবুর ছেলের বউ গীতা নট্ট।
|
ঢোলের রাজা ক্ষীরোদ নট্ট।
|
|
ঢোলের ব্যবহার কমেছে গোটা বাংলাতেই। ঢাকি আছেন অনেক, ঢুলি নেই বললেই চলে। কেন? পেশায় ঢোলবাদক কলকাতার বাবলু বিশ্বাস, “ঢোলের বোল শেখা বেশ শক্ত। বাংলায় ঢোলের বোল শেখানোর গুরুর অভাব। তাই নতুন শিল্পীরা ঢোলের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।”
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্র সঙ্গীত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান গৌতম ঘোষ বলেন, “ঢোলের ইতিহাস প্রায় তিন হাজার বছরের। পশ্চিমবঙ্গে যে ঢোল ব্যবহৃত হয় তাকে বলে বাংলা ঢোল। তবলা কিংবা পাখোয়াজের চাইতে অনেকটা বেশি চামড়া ঢোল বানাতে। চামড়ার দাম দিন দিন বাড়ছে। আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার বাংলা ঢোলকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে।”
কিন্তু ঢোলের শব্দ? তার জুড়ি মেলা ভার। বাবলুবাবু জানান, শিল্পীরা অনুষ্ঠানে সাউন্ড সিস্টেমে ঢোলের রেকর্ড ব্যবহার করছে। ‘বাংলাদেশের ঢোল’ হয়ত শুধুই রিমোট-চালিত শব্দ হতে চলেছে।
|
শান্তনু হালদারের তোলা ছবি। |