ফিরে চল মাটির টানে!
এ বারের পুজোর গানে এটাই যেন মূল সুর। বহু দিন পরে ঢাকের কাঠি ছাপিয়ে ভেসে আসছে লোকগানের সুর। ‘মাহুত বন্ধুরে’ থেকে ‘হৃদমাঝারে রাখব যেতে দিব না’। পুজোর গানে লোকসুরের হাত ধরেই কলকাতা-মুম্বইও যেন একাকার হয়ে গেল।
জনপ্রিয়তার দৌড়ে পাল্লা দিচ্ছেন তিন শিল্পী। ‘মাহুত বন্ধুরে’-র ইন্দ্রনীল সেন, ‘হোয়াট দ্য ফোক’-এর বাবুল সুপ্রিয়, ‘প্রাণটা জুড়াইয়া গেল রে’-র অভিজিৎ। কয়েক বছর ধরেই পুজোর গানে ভাটা চলছিল। হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত, নয় পুরনো বাংলা গান। শরত এলেই নতুন গানের জন্য হা-পিত্যেশ ভুলতে বসেছিল বাঙালি।
ইন্দ্রনীলের কথায়, “পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। আমার জীবনের শুরুই তো ছিল লোকগান দিয়ে। জেলায় ঘুরতে ঘুরতে মনে হয়েছে লোকগানের সুর এখনও মানুষকে প্রভাবিত করে। পরিবর্তনের যুগে শ্রোতাদের রুচির পরিবর্তনও তো ভেবে দেখতে হবে।” বাবুল সুপ্রিয় বলছেন, “সোহাগ চাঁদ’ ও ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িতে গেলাম’ এতটাই শ্রোতাদের গভীরে নাড়া দিয়েছে যে আমার সব পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলেই এখন মনে হচ্ছে।” আঁচ পেয়েছিলেন মুম্বইয়ের অভিজিৎ-ও। “জীবনে বহু গান করেছি। কিন্তু এই লোকগান গেয়ে যা আনন্দ পেয়েছি তা কোনও দিনও ভুলব না,” বললেন তিনি। |
পুজোর গানের রেকর্ডিং-এ ইন্দ্রনীল সেন। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী। |
সত্যিই কি বিক্রির নিরিখে এ বার পুজোয় লোকগানের দাপট বাড়ল? মানছেন দক্ষিণ কলকাতার এক সুপরিচিত সিডি ব্যবসায়ীও। তাঁর মতে, “ওই তিন শিল্পীর গানের চাহিদার পাশাপাশি আরও কিছু লোকগানের বিক্রি বেড়েছে যা আগে কখনও হত না। এমনকী বাংলা ব্যান্ডের কেউ কেউ লোকগান দিয়ে ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলে দিয়েছেন।” যেমন সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ফকিরা’। সুরজিৎ নিজেও এর বিক্রিতে অবাক। বলছেন, “প্রতি বছর আধুনিক ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংকলন নিয়ে শ্রোতাদের দরবারে যাচ্ছিলাম। এ বার সেই নিয়ম ভাঙতে লোকগীতির হাত ধরেছিলাম। এমনটা হবে ভাবিনি।”
তবে উত্তর কলকাতায় লোকগানের পাশাপাশি ভালই বিকোচ্ছে পুরনো দিনের বিভিন্ন গানের সংকলন। লতা, আশা, কিশোর, হেমন্ত, মান্না থেকে ঢাকের বাদ্যি। বাদ যাচ্ছেন না দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ বা রজনীকান্তও। নীলা মজুমদার, নূপুরছন্দা ঘোষদের সংকলনগুলি ভালই বিক্রি হচ্ছে বলে দাবি। তালিকায় আছে দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়ের থিয়েটারের গানও। তবে উল্লেখযোগ্য, উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতার বেশ কিছু সিডি ব্যবসায়ী অবাক হয়েছেন, এই প্রথম বাংলা ব্যান্ডের কিছু দেশাত্মবোধক গানের সংকলন পুজোর পছন্দের তালিকায় এবং বিক্রির পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। উস্তাদ রাশিদ খান, শান প্রমুখ শিল্পীর ‘দেখা হবে এই বাংলায়’ সংকলনটিও আশা জাগানো সাড়া পাচ্ছে।
এটা কি তবে নিঃশব্দ পরিবর্তন?
এতটা না ভাবলেও পরিবর্তনে গা ভাসিয়েছেন সারেগামা-র এস এফ করিমও। স্বীকার করলেন, “পুজোয় আধুনিক গানের সংকলনের পাশাপাশি লোকগীতির অ্যালবাম ‘রাই’ ও বেরোচ্ছে।” সাগরিকার বরুণ নন্দীও পুজো সংকলনে তার ব্যতিক্রম করেননি। কিন্তু লোকগীতির এই চাহিদা দেখেই বাংলা গানের এ এক আমূল পরিবর্তন, এমনটা মানছেন না রাজকল্যাণ রায়, স্বরূপ পাল, সুমন চট্টোপাধ্যায়-সহ কলকাতারই বিভিন্ন সিডি কোম্পানির কর্ণধারেরা। তাঁদের বক্তব্য, “পুজোর সময় এই ধরনের চাহিদা অত্যন্ত সাময়িক। সারা বছরের চাহিদা ও বিক্রি-ই বলে দিতে পারে, সত্যিই লোকগানের এই ট্রেন্ড আগামীতেও বজায় থাকবে কি না।” |
অর্থাৎ গান নিয়ে সেই অনিশ্চয়তা। নব্বই দশকের পর হারিয়ে গেল নতুন গানের সেই আমেজও। কেন? হৈমন্তী শুক্লর আক্ষেপ, “কথা ও সুরের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে তা কখনও মনে দাগ কাটবে না। দিনের পর দিন পরিশ্রম করেই একটি গানকে তুলে ধরতে হয়।” এই প্রজন্মের রাঘব চট্টোপাধ্যায়, মনোময় ভট্টাচার্য বা রূপঙ্কর অবশ্য মনে করেন, ‘‘ইদানীং বেশ ভাল ভাল আধুনিক গান বাজারে আসছে।”
তর্কবিতর্কে এখন শুধুই অপেক্ষা, সময়ের। |