গত বছর নবমীর ভোররাতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। এ বছরের কোনও শারদ-সংখ্যায় তাই নেই দিকশূন্যপুরের হাতছানি।
সপ্তাহ দেড়েক আগে নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বরে পুরনো বই বিক্রির ‘বইবাজার’। একাধিক স্টলে তাঁর সহাস্য প্রতিকৃতি। শারদ-সংস্কৃতিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তেই।
তবু এক ভাবে সপ্তমীর সকালেই ফিরে আসছেন তিনি। সুনীল-শূন্যতার মাঝেই মুক্তি পাচ্ছে সন্তু-কাকাবাবুর ‘মিশর রহস্য’। বাংলা সংস্কৃতির ক্যালেন্ডার ওল্টালে দেখা যাবে, চার দশক আগে এক অক্টোবর মাসেই রিলিজ করেছিল তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সম্পাদক। নামজাদা তরুণ কবি ও লেখক। ১৯৭০ সালের কথা। তার এক বছর পরেই আত্মপ্রকাশ করবে সন্তু-কাকাবাবু।
“পুজোয় নানা লেখার চাপ থাকত, তবু কাকাবাবুটা লিখতে বরাবর ভালবাসত,” বলছিলেন স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। কে না জানে, কাকাবাবু রাজা রায়চৌধুরী বাংলা কিশোর-সাহিত্যের উজ্জ্বল উদ্ধার। তিনি পূর্বসুরি ব্যোমকেশ বক্সি, ফেলুদা কিংবা উত্তরসূরি অমল সোম, মিতিন মাসিদের মতো শুধুই প্রাইভেট ডিটেক্টিভ নন। সিবিআই-এর নরেন্দ্র বর্মা এবং ভারত সরকারের বিভিন্ন দফতর তাঁকে নানা ভাবে সাহায্য করেন। প্রত্নতত্ত্বে আগ্রহী কাকাবাবু কাশ্মীরে ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ এক অভিযানে সন্তুকে নিয়ে কণিষ্কের মুণ্ডুও খুঁজে বের করেছিলেন। পরে সেটি ঝিলম নদীর জলে পড়ে যায়। “বাঁধাধরা ডিটেক্টিভ গল্পটা ও লিখতে চাইত না। এমনিতে সিমেনঁ বা আগাথা ক্রিস্টি পড়তে ভালবাসত। কিন্তু বলত, হু-ডান-ইট লিখতে ওর ভাল লাগে না,” বলছিলেন স্বাতী। বাংলা কিশোর-সাহিত্যে তাই কাকাবাবু সার্থক থ্রিলার-সিরিজ। |
সুনীলের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে সেই থ্রিলারই কিন্তু হতে চলেছে বাংলা সিনেমার প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি। প্রযোজক ভেঙ্কটেশ ফিল্মস আগামী সাত বছরের জন্য তিনটি কাকাবাবু উপন্যাসের স্বত্ব কিনেছে। ওই সময়সীমার মধ্যে তাঁরা ছাড়া আর কেউ কাকাবাবু নিয়ে ছবি করতে পারবেন না। হাল আমলে ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ বাংলা সিনেমায় এসেছেন ঠিকই, কিন্তু বিভিন্ন প্রযোজকের ব্যানারে। কাকাবাবুর ব্যবসা-স্বত্ব তার চেয়ে আঁটোসাঁটো। জর্জ লুকাসের ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ নিয়ে হলিউডে যেমন প্যারামাউন্ট স্টুডিও হরেক ছবি তৈরি করেছে, সে রকম। ‘মিশর রহস্য’ তারই প্রথম ধাপ। এ ছবিতে ডিজিটাল এডিটিং-এ ব্যবহৃত হয়েছে নতুন প্রযুক্তি। “মরুভূমিতে সকালে, দুপুরে বালির রং বদলায়। স্ফিংক্সের সামনে বালির রং আর টেক্সচার এক রকম। অন্য জায়গায় আর এক রকম। ফলে সমতা বজায় রাখতে ওই প্রযুক্তি ব্যবহার। বেশ সময়সাপেক্ষ, রং-তুলি নিয়ে কাজ করার মতো,” বলছিলেন ডিজিটাল আর্টিস্ট শমীক চট্টোপাধ্যায়।
তবে শুধু ফিল্মি প্রযুক্তি দিয়ে নতুন কাকাবাবুকে বোঝা দুষ্কর। এই প্রথম বাংলা ছবিতে উঠে আসছে মিশরের ‘তাহরির স্কোয়ার’-এর ইঙ্গিত। বীজটা ছিল সুনীলের ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত গল্পেই। সেখানে মিশরের শিক্ষিত যুবক হানি আলকাদি তাঁবুতে বসে শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ পড়েন। দেশের মানুষকে মুক্তি দিতে বিপ্লবী দল তৈরি করতে চান তিনি। কাকাবাবু তাকে সাহায্য করেন। পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় এর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
কাকাবাবু সাহায্য করে এসেছিলেন বলেই তো হানি আলকাদিরা ‘জুঁই বিপ্লব’ ঘটাতে পারলেন!
এবং সেখানেই শেষ নয়। সিনেমায় কাকাবাবুর সংলাপ, ‘বিপ্লবের পরও তুমি হানি আলকাদি হয়েই থেকো। ভারতীয় নেতাদের মতো হয়ে যেও না।’ শ্যুটিং করতে করতেই বোঝা গিয়েছিল কি, সিংহাসনে বসার পর মহম্মদ মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুড একই পথে হাঁটবে, গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরবে? “আঁচ করেছিলাম। কিন্তু লাইনটা ভবিষ্যদ্বাণী হবে, বুঝিনি,” হাসছেন পরিচালক।
এত সমসাময়িকতার ইঙ্গিতে অক্ষুণ্ণ থাকবে তো কাকাবাবু-স্পিরিট? সেটাই টেনশন, বলছেন প্রসেনজিৎ। নতুন কাকাবাবু! “আমাদের ছোটবেলার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে চরিত্রটা। তাই একটাই টেনশন। সুনীলদার স্পিরিটটা বজায় রাখা গেল কিনা!” কে না জানে, আফগানিস্তানের পাহাড়ে কাকাবাবুর পা জখম হয়ে যায়, ক্রাচ নিয়ে হাঁটাচলা করেন। “ছোটদের গল্প। তাই দেখাতে চেয়েছি, হাত-পা চলে যাওয়া বা দুর্ঘটনাই সব নয়। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে, কিন্তু মনের জোর বজায় রাখলে তার পরও এগিয়ে যাওয়া যায়,” সাক্ষাৎকারেই বলতেন সুনীল! ’৭৯ সালে তপন সিংহের ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ কাকাবাবুকে নিয়ে প্রথম ছবি। সেখানে শমিত ভঞ্জ দু’বগলে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতেন, সন্তুকে প্রায়ই বলতেন, ‘এমনি বলে কোনও কথা নেই, সব কিছুর পিছনে একটা কারণ থাকে।’ তার পর সব্যসাচী চক্রবর্তীকেও দেখা গিয়েছে কাকাবাবুর বেশে। কিন্তু নতুন কাকাবাবু অন্য রকম। হ্যান্ডহেল্ড ক্রাচ। টুইট করেন। রাশভারি নন। সন্তুর প্রেমে নীরব উস্কানি দেন।
কুড়ি বছর আগে ‘মিশর রহস্য’-র অন্যতম আকর্ষণই ছিল ওই টিন-এজ প্রেম। তার আগে ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ বা ‘খালি জাহাজের রহস্য’-য় ছিল না সন্তুর বান্ধবী। মিশর রহস্যে কিন্তু কায়রো বিমানবন্দরে রিনি সন্তুকে জিজ্ঞেস করে, ‘কি রে, কলকাতায় বললি না তো, এখানে আসবি।’ সন্তুর উত্তর: ‘আমরা কখন যে কোথায় যাব, ঠিক থাকে না। আজ কায়রো, পরশুই হয়তো মস্কো চলে যাব।’ রিনি হাসে, ‘ইস, চাল মারিস না। আমরা-আমরা করছিস কেন রে? তুই তো কাকাবাবুর বাহন।’ এবং তার পরই সুনীলের অমোঘ লাইন, ‘কলকাতায় থাকতে রিনি কায়রো বেড়াতে আসছে শুনে সন্তুর ঈর্ষা হয়েছিল। এখন তার মনে হল, এই সব অবোধ মেয়ের সঙ্গে কথা বলার অর্থই হয় না।’ পরিচালকও এই জায়গায় স্মৃতিকাতর, “ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল। তখন শারদীয়া আনন্দমেলায় গল্পটা পড়ে মনে হয়েছিল, যাক বাবা, এই ভদ্রলোকের বাতিক নেই। অন্তত আমাদের প্রেমের কথা আমাদের ভাষায় বলেন।”
সপ্তমীর আনন্দ-উজ্জ্বল বিকেলে স্বাতী অবশ্য নতুন কাকাবাবুকে দেখতে যাচ্ছেন না। ওই সময় তিনি কলকাতা থেকে বহু দূরে, হিমাচলের পাহাড়ি শহরে। “ফিরব লক্ষ্মীপুজোর পর।” আলো-উজ্জ্বল সপ্তমী, নতুন ছবির মুক্তি, একডালিয়া এভারগ্রিনে পুজোর ভিড় সব থেকে যাবে। শুধু নবীন কবির হাতে ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ তুলে দেওয়ার কেউ থাকবেন না।
তবু কাকাবাবু ফিরে আসবেন! |