উত্তেজনার প্রহর কেটে গেলেও বৃহস্পতিবার গোটা দিনটাই ওয়াশিংটন ডিসির বাসিন্দাদের তাড়া করেছে আতঙ্ক আর প্রশ্ন। আতঙ্ক কারণ মাত্র সপ্তাহ তিনেকের ব্যবধানে ফের আক্রান্ত খাস মার্কিন রাজধানী। আর প্রশ্ন, কেন হঠাৎ করে ক্যাপিটল বিল্ডিং-এর সামনে এমন বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ খোয়ালেন অভিযুক্ত মিরিয়াম কেরি?
এর জবাব খুঁজতে গিয়ে শুরুর দিকে বিভ্রান্ত ছিলেন এফবিআই ও পুলিশকর্মীরা। তবে, বৃহস্পতিবার রাতের দিকেই তাঁরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান, মানসিক অসুস্থতার জেরেই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন কানেক্টিকাটের ওই কৃষ্ণাঙ্গ বাসিন্দা। মিরিয়ামের মা জানিয়েছেন, গত বছর অগস্টে কন্যাসন্তানের জন্মের পরই ‘পোস্টপারটাম ডিপ্রেশনে’ আক্রান্ত হন মিরিয়াম। হাসিখুশি বছর চৌত্রিশের ‘ডেন্টাল হাইজিনিস্ট’ তার পর থেকেই হয়ে উঠেছিলেন বদমেজাজি। রোগীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের জন্য চাকরিও খোয়ান। বেড়ে যায় রোগ। সম্প্রতি ভাবতে শুরু করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর পিছু নিয়েছেন। আর সেই ‘ডিলিউশনের’ জেরেই বৃহস্পতিবার নিজের ইনফিনিটি লাক্সারি সেডান চালিয়ে হোয়াইট হাউস লাগোয়া চত্বরে ঢুকে পড়েন।
গাড়ির গতি তখন ঘণ্টায় ৮০ মাইল। হোয়াইট হাউস লাগোয়া রাস্তায় নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভেদ করে বেরিয়ে গেল কানেক্টিকাটের নাম্বার প্লেট লাগানো সেডান। থামানোর চেষ্টা করল পুলিশ। কিন্তু গাড়ি থামল না। লক্ষ্যহীন সেডান তখন বেপরোয়া। কখনও ডানে, কখনও বা বাঁয়ে। শেষমেশ গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালালেন ‘সিক্রেট সার্ভিস’ এবং মার্কিন ক্যাপিটল পুলিশ কর্মীরা। পর পর প্রায় পনেরোটা। যেখানে গাড়ি থামল, সেখান থেকে ‘ক্যাপিটল বিল্ডিং’ প্রায় ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। গোটা ঘটনায় আহত হয়েছেন দুই পুলিশকর্মী। দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে পুলিশের গাড়িও। মিরিয়ামের বুলেটবিদ্ধ গাড়ির পাশে যখন পুলিশ পৌঁছয়, তত ক্ষণে প্রাণ হারিয়েছেন মিরিয়াম। গাড়ির পিছনের সিটে অক্ষত বসে রয়েছে তাঁর আঠারো মাস বয়সী মেয়ে এরিকা। আপাতত সে শিশু পরিষেবা কর্মীদের হেফাজতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে গোটা বিষয়টি জানানো হয়েছে। |
বেপরোয়া মিরিয়ামকে থামাতে গিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে পুলিশের
এই গাড়িটি। ওয়াশিংটন ডিসি-তে। ছবি: এপি। |
মিরিয়ামের গাড়ি ধাওয়া করা থেকে শুরু করে গুলিবর্ষণ এবং অবশেষে এরিকাকে উদ্ধার এই গোটা পর্বের মেয়াদ ছিল মেরেকেটে আধ ঘণ্টা। কিন্তু তার জেরেই এক ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে যায় আইনসভার কাজকর্ম। কী ভাবে প্রশাসনের কাজ ফের শুরু করা যায়, তা নিয়েই তখন আলোচনা চলছিল ক্যাপিটাল বিল্ডিং-এ। আর ঠিক সে সময়ই গুলির আওয়াজ। লাগোয়া পেনসিলভেনিয়া অ্যাভিনিউয়ে তখন ‘কার-চেজিং’-এর টানটান চিত্রনাট্য। বাজছে সাইরেন। হতভম্ব পথচারীরা। কেউ কেউ আবার আতঙ্কিত। এরই মধ্যে গুলিবর্ষণ শুরু করেছে পুলিশ। আইনসভার সদস্যদের জন্য বারবার পুলিশি প্রচার যে যেখানে আছেন, বসে পড়ুন। কিছু ক্ষণ পর স্বাভাবিক হল পরিস্থিতি।
দেখেশুনে আইনসভার সদস্যদের অনেকেরই দাবি, যে সব পুলিশকর্মী আজ বড়সড় ঝামেলা থেকে বাঁচালেন মার্কিন রাজধানীকে, তাঁরা কিন্তু সরকারের ‘শাট ডাউনের’ জেরে বেতন পাচ্ছেন না। তবুও কাজে আসতে হচ্ছে তাঁদের। কারণ তাঁরা ‘অপরিহার্য’। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে তাঁরা যে সত্যিই অপরিহার্য তা বৃহস্পতিবারের ঘটনা ফের প্রমাণ করল। অন্তত সেই কর্মীদের বেতন দিতেই শীঘ্র কাজে ফিরুক সরকার, এমনটাই দাবি একাংশের।
তবে সব পেরিয়ে আতঙ্কের ছায়া যেন জাঁকিয়ে বসছে। ওয়াশিংটনে নৌবাহিনীর দফতরে বন্দুকবাজের হানার ঘটনার পর তিন সপ্তাহও কাটেনি। তার মধ্যেই এই হামলা। বার বার সাধারণ নাগরিকের হাতেই বিপর্যস্ত হচ্ছে মার্কিন রাজধানী। সে ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত জঙ্গি-হামলা হলে কী অবস্থা হবে, তা ভেবেই অস্বস্তিতে প্রশাসন। আতঙ্কিত বাসিন্দারা।
বৃহস্পতিবারের ঘটনায় দিশেহারা এফবিআই প্রথমে এটিকেও জঙ্গি-হামলা ভেবেছিল। পরে অবশ্য জানা যায় অস্ত্র বা বিস্ফোরক, কোনওটাই ছিল না মিরিয়ামের কাছে। তবুও নিশ্চিত হতে কানেক্টিকাটের স্ট্যামফোর্ডের যে আবাসনে থাকতেন মিরিয়াম, তা ঘিরে ফেলে এফবিআই। আবাসনের ছাদের উপর উড়তে শুরু করে তিনটে চপার। জড়ো হয় আপৎকালীন ব্যবস্থা সামলাতে বিশেষ গাড়ি। আবাসনের বাকি বাসিন্দারা অবশ্য তখন বাড়ির বাইরে। তল্লাশি শেষ হলে ঢুকতে পান তাঁরা।
তার পরেই জানা যায়, মিরিয়ামের অসুস্থতার কথা। যার জেরে বোনের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় মিরিয়ামের। সন্তানের জন্মের পর এক বার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হন। আর তার পর থেকেই পোস্টপারটাম ডিপ্রেশনের শিকার তিনি।
সেই রোগই প্রাণ কাড়ল মিরিয়ামের। একই সঙ্গে প্রশ্ন তুলে দিল পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর দেশের রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও। |