বিদ্যুৎ নেই, চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাতে একটা লন্ঠন নিয়ে কোনও মতে নিজের দোকানে ঢুকে পড়েছিলেন ফজল বিরানি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। দোকান ভর্তি দামি দামি জামা-কাপড় একটাও নেই। স্যুট-টাই সব উধাও! অন্ধকারে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে পোশাকহীন ম্যানিকুইনগুলো!
রক্ষকই কি ভক্ষক? নাইরোবির ওয়েস্টগেট শপিং মল-এর হাল দেখে এখন একটাই প্রশ্ন কেনিয়াবাসীর।
দু’সপ্তাহ আগে এই মলেই দাপিয়ে বেড়িয়েছে জঙ্গিরা। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে মেরেছে ৬৭ জনকে। তার পর সেনা-জঙ্গি দীর্ঘ গুলির লড়াই। জঙ্গির কবলমুক্ত করতে গিয়ে ভেঙে পড়েছে বাড়িটির একটি অংশ। বিদ্যুৎ নেই, অন্ধকারে ডুবে নাইরোবির সম্ভ্রান্ত এলাকার শপিং মল ওয়েস্টগেট।
২১ সেপ্টেম্বর ঘটনার পর এ ক’দিন সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি ওয়েস্টগেটে। ভিতরে তখন শুধুই ভারী বুটের আওয়াজ, উর্দি পরা সেনার আনাগোনা। আজ ভিতরে গিয়েই দোকানমালিকদের চক্ষু চড়ক গাছ! জঙ্গিরা গুলি চালিয়ে মানুষ মেরেছে, জানা ছিল। কিন্তু মলের তামাম মালপত্র গায়েব করল কে? হামলার দিন জঙ্গিদের কয়েক জনের হাতে পানীয়ের ক্যান দেখা গিয়েছিল বটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেওছেন সে কথা। কিন্তু তাই বলে জামাকাপড়, গয়না, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ঘড়ি মানে, একটা আধুনিক শপিং মলে যা কিছু বিক্রি হয় গেল কোথায়? জঙ্গিরা তো মরে গিয়েছে। সাধারণ মানুষের পা পড়েনি। সেনা ছাড়া আর কেউ তো ওয়েস্টগেটে ছিল না! তবে? |
হামলার পর ওয়েস্টগেট মলের ভাঙা দোকানগুলি খাঁ খাঁ করছে।—ফাইল চিত্র। |
সাধারণ মানুষ বলছেন, প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। যে সেনা ক’দিন আগে জঙ্গিদের সঙ্গে লড়ে নাম কিনেছে, সেই সেনাকেই এখন চোর-ডাকাত বলে গাল পাড়ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এতে ওঁদের বিশেষ হেলদোলও নেই। নিজেরাই বলছেন, দেশে দুর্নীতি যে মাত্রায় পৌঁছেছে, তাতে সেনা জওয়ানেরা জিনিসপত্র সরাবেন, এ আর আশ্চর্য কী?
কেনীয়দের অধিকাংশই নিশ্চিত, চোর আসলে সেনাই। অনেকে এমনও বলছেন, রীতিমতো পরিকল্পনা করেই শপিং মল থেকে লোকজনকে বের করে দিয়েছিল সেনা। ২১ তারিখ জঙ্গি-হানার পরও বেশ কয়েক দিন ধরে ওয়েস্টগেট থেকে ভেসে এসেছে গুলির আওয়াজ। বাসিন্দাদের কারও কারও মতে, সেটাও হয়তো সাজানো। জঙ্গিরা হয়তো মরেই গিয়েছিল। বাড়িটাকে দখল করে রেখে ধীরে-সুস্থে চৌর্যবৃত্তি সারতেই হয়তো ওই পন্থা বেছে নিয়েছিল সেনা। গুলির আওয়াজে লোকে ভাবছিল, জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই চলছে। লুঠতরাজ নিয়ে দর্শকদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল একটি টিভি চ্যানেলে। ৭৭ শতাংশ দর্শক বলেছেন, “সেনাই দায়ী।” সর্ষের মধ্যে যেমন ভূত থাকে, সেনার মধ্যেই চোর আছে।
এখন ওয়েস্টগেটে ঢুকলেই নাকে আসছে পচা মাংসের গন্ধ। মুখে গ্যাস-মুখোশ পরে প্রমাণ সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সেনা। বাসি রক্তের ছাপ এখানে সেখানে। গত কালও ধ্বংসস্তূপের তলা থেকে কয়েকটি দেহ মিলেছে। এর মধ্যেই ওয়েস্টগেটে ঢুকে পড়েছিলেন ফজল বিরানি। কত দিন নিজের দোকানটাতে যেতে পারেননি। জানতেন না, কী অপেক্ষা করে রয়েছে। কয়েক ডজন দামি দামি স্যুট উধাও। ফজল বললেন, “এক-একটার দাম ২০০০ ডলার।”
দোকানের অবস্থা দেখে আর থাকতে পারেননি ফজল। ছুটে যান উপরের তলায়। সেখানে আরও কয়েক জন দোকান মালিক ছিলেন। বারান্দায় কাচের গুঁড়ো ভর্তি। তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা। হাঁফাতে হাঁফাতেই ফজল বললেন, “তোমাদেরও কি সব চুরি হয়ে গিয়েছে?” অমনি ক্ষোভে ফেটে পড়লেন বুটিকের মালিক মাইকেল ওয়াউরু। ফজলকে বললেন, “বোকার মতো কথা বোলো না। সবার সব চুরি হয়ে গিয়েছে।” কী নেই সেই তালিকায়? ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, সুইস ঘড়ি, ক্যামেরা, পারফিউম, স্টিরিও স্পিকার এমনকী অন্তর্বাসও। এক মহিলা জানালেন, তাঁর বুটিকে ব্লাউজ, গয়না, ব্যাগ, সর্বস্ব চুরি হয়ে গিয়েছে। “কে করেছে এ কাজ?” চেঁচিয়ে উঠলেন একটি বড় সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর। “যাঁরা ভিতরে ছিল, তাঁরাই নিশ্চয় করেছে। অর্থাৎ সেনা।” বেশ কিছু দোকানে টেবিলের উপরে বসানো রয়েছে খালি পানীয়ের গেলাসও। মালপত্র সরানোর ফাঁকে পানভোজনও ভালই চলেছে বলে মানুষের সন্দেহ।
প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াট্টা গোটা ব্যাপারটা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। সেনার তরফেও জনতার কাছে বার্তা, কারও কাছে প্রমাণ থাকলে তদন্তে সাহায্য করুন। কিন্তু এ সব হেলায় উড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। ভরসা নেই তাঁদের। কবে তদন্ত মিটবে এবং তাতে কতটা বেনো জল মিশবে, সে নিয়ে বিস্তর সন্দেহ ওঁদের। তা ছাড়া তদন্ত চললেও চুরির সাক্ষী নেই। আর সিসিটিভি ফুটেজও তো সরকারি গোয়েন্দাদের হাতে। বাসিন্দারা নিজেরাই বলছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে কেনিয়া। কিন্তু জঙ্গি-হানায় যখন অতগুলো মানুষ খুন হয়ে গেল, তখনও এ ধরনের লুঠতরাজের নিদর্শন কেনিয়ার অতীতেও নেই।
ওয়েস্টগেটের ভিতরে এখন ছড়িটি-ছিটিয়ে চুরির চিহ্ন। ক্যাশ বাক্স ভাঙা। এমনকী দেওয়ালে একটা বড় ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি ছিল। সেটাও তুলে নিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা। হেসে এক মহিলা বললেন, “চার দিন ধরে কী চলছিলএখানে? যুদ্ধ নাকি কেনাকাটার উৎসব?” সে হাসিতে বিষাদের ছায়া স্পষ্ট। |