শরতের নীলেও মেঘলা মন চিনাকুড়ি কলোনির |
প্রকৃতিতে পুজোর ছোঁয়া লেগেছে আগের মতোই। কিন্তু কাশ আর নীল আকাশও মেঘলা কাটাতে পারছে না ডিপিএসসি-র চিনাকুড়ি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মী আবাসন কলোনিতে।
বছর দুই আগেও শিল্পাঞ্চলে শারদোৎসবের রোশনাইয়ে বিদ্যুৎ জুগিয়েছে এই কেন্দ্র। কিন্তু তার পর নিজেই ডুবে গিয়েছে অন্ধকারে। প্রায় ১৪ মাস ধরে বন্ধ পড়ে রয়েছে সেটি। থমকে গিয়েছে শ্রমিক কর্মীদের দুর্গাপুজোও। তাঁদের সম্বল এখন শুধুই স্মৃতি। আর এই স্মৃতিতে মেদুর হয়েই পুজোর চার দিন কলোনি ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না বলেও ঠিক করেছেন আবাসিকেরা।
১৯৯১ সালে উৎপাদন শুরু হয়েছিল এই কেন্দ্রের। ইসিএলের তৈরি করে দেওয়া কেন্দ্রটি কুড়ি বছরের জন্য লিজ নেয় ডিসেরগড় পাওয়ার সাপ্লাই কর্পোরেশন। সেই লিজের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১২ সালের ৩১ মার্চ। কিন্তু চুক্তি নবীকরণ না করায় উৎপাদন গুটিয়ে নিয়েছে ডিপিএসসি। সংস্থার ১৪৭ জন শ্রমিক-কর্মীকে স্বেচ্ছাবসর নিতেও বলেছেন কর্তৃপক্ষ। অনেকে তা নিলেও প্রায় তিরিশ জন এখনও মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন। ১৪ মাস ধরে বেতনও পাচ্ছেন না তাঁরা। কিন্তু আধপেট খেয়েও তাঁদের আশা, যদি লিজ চুক্তি নবীকরণ হয় বা অন্য কোনও সংস্থা লিজ নেয় তবে তাঁরা আবার কাজ পাবেন। |
কিন্তু পুজো যত কাছে আসছে ততই চোখের কোন ভিজে উঠছে এঁদের। স্থানীয় বরুণ চৌধুরী কলোনিতে ঢোকার মুখে বাঁ দিকের জঙ্গল ঘেরা মাঠটা দেখিয়ে বললেন, “এখানেই আমাদের মণ্ডপ হত। মহালয়ার দিন থেকে সাজ সাজ রব শুরু হয়ে যেত।” এখন অবশ্য আগাছার জঙ্গল দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তনুশ্রী রায়। তিনি জানান, চারটে দিন বাড়ির হেঁশেল বন্ধই থাকত। সকাল থেকে রাত, খাওয়া দাওয়া, আড্ডা সবই হত মণ্ডপে। আর এ বার? তনুশ্রীদেবী বললেন, “প্রায় ১৫ বছর এখানে বাস করছি। এরকম দিন দেখতে হবে ভাবিনি।” দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল মজুমদার জানাল, ফি বছর তার কাজ ছিল সামনের দামোদর থেকে কলসি ভরে মাথায় করে পুজোর জল মণ্ডপে নিয়ে আসা। গত বছরেও এনেছে। কিন্তু এ বছর আর তার দরকার হবে না। তাই পুজোর চারদিন বাড়ি থেকেই বেরোবে না ঠিক করেছে রাহুল। সে আরও বলে, “স্কুলে গিয়ে ঠাকুর গড়তে দেখছি আর আমার পুজোর কথা মনে পড়ছে। কিছু ভাল লাগছে না।”
অভাবের মধ্যেও গত বছরও কলোনির বাসিন্দারা পুজো করেছিলেন। আড়ম্বর ছিল না, কিন্তু প্রাণ ছিল। কোম্পানি কুড়ি হাজার টাকা অনুদানও দিয়েছিল। কিন্তু এ বার আর কোনও উচ্চবাচ্য করেননি কেউ। কর্মীরা উদ্যোগী হলেন না কেন? ক্যানসারে আক্রান্ত প্রভাত মজুমদার বললেন, “দু’বেলা খেতে পাচ্ছি না। এলাকার দোকানগুলো ধার বাকি রেখে আর কিছু দিতেও চাইছে না। বাড়ির কারও জন্য একটা নতুন সুতোও কিনতে পারিনি। এক বছর ধরে বিনা চিকিৎসায় দিন কাটাচ্ছি। এর পরেও পুজো?” লজ্জায় নিজের সাত বছরের ছেলের মুখোমুখি হতে পারছেন না দীপক কর্মকার। তিনি বলেন, “রোজ স্কুল থেকে ফিরেই ছেলের প্রশ্ন, বন্ধুদের জামা হয়েছে। আমায় কবে কিনে দেবে?” উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী অর্পিতা যাদব অবশ্য বাবাকে একবারও নতুন জামার কথা বলেনি। কারণ সে জানে, গত একবছরে তার পড়াশোনার খরচ জুগিয়ে সংসার টেনে নিয়ে যেতে বাবাকে কতটা হিমসিম খেতে হয়েছে। তবুও মন খারাপ পিছু ছাড়ছে না তার। আগের বছর যেখানে আড্ডা মেরে দিন কেটেছে এ বার সেখানে ঘন আগাছা দেখে অর্পিতা বলে, “গত ১৫ বছর পুজোর সময় কখনই কোথাও যাই নি। এ বছরও যাব না। তফাত একটাই, পুজোটাই আর নেই।”
উৎপাদন যে দিন থেকে বন্ধ, সে দিন থেকেই কারখানার গেটে ধর্নায় বসেছেন শ্রমিক কর্মীরা। একটাই দাবি, যেই এই কেন্দ্রের লিজ নিক সে যেন শ্রমিক কর্মীদের বহাল রাখে। বহু জায়গায় বহু বার তদ্বির করেছেন তাঁরা। কিন্তু আশার আলোর দেখা মেলেনি। সম্প্রতি অন্ডালে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে দিনও কারখানার শ্রমিক কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সকলে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিজেদের দুর্দশার কথা জানিয়েছেন। এখন তিনিই ভরসা এঁদের।
|