|
|
|
|
|
ওগো আমার আগমনী আলো
সুচেতনা সরকার
(ক্রয়ডন, লন্ডন) |
এখনো তেমন করে ঠান্ডা জেঁকে ধরেনি লন্ডন শহরটাকে। ফিজিক্স ল্যাবের লোহাচূর আর দস্তার পাত ভেদ করে হঠাৎ জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সামনের বিশাল সবুজ মাঠটা ধুয়ে যাচ্ছে সোনালি শরত্ আলোয়। সারি সারি পাইন-মেপল-সিডার-বার্চ গাছগুলো বেশ তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কে জানে কবে বলতে কবে আবার শীত এসে জাপটে ধরে! শরত্ তো সেই ভয়ঙ্কর শীতের কথাই বয়ে আনে প্রতি বছর। তবু শরত্ মানে তো আমাদের মত প্রথম প্রজন্মের ভারতীয়দের কাছে ‘আগমনীর আলো’। পুজো আসছে যে! শিউলি না হয় নাই বা হল কিন্তু এখানেও প্রচুর কাশফুল ফুটেছে— যার পোষাকি সাহেবি নাম প্যাম্পাস গ্রাস। হাওয়ার সঙ্গে সে দিব্বি মাথা দোলায় আমাদের দেখলে। কবি তো কবেই বলেছেন— টেমসের দক্ষিণ কূল, কলিকাতা সমতুল। গত দশ বছরে প্রচুর বাঙালি পাড়ি জমিয়েছে দক্ষিণ লন্ডনের এই বর্ধিষ্ণু জনপদটিতে— ক্রয়ডন যার নাম। ধীরে ধীরে নিজের অজান্তেই এই শহরটাই বদলে গিয়েছে আমাদের কাছে। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে মাঝে মাঝেই বাংলা কথা শুনতে পাওয়া যায়। দেশি দোকানে স্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নিয়েছে রুই-ইলিশ, এমনকি কই-মাগুর অবধি। পুঁইশাক-কচুর লতি, পাটালি গুড়ের বাঙালিয়ানা আর বিলাসিতা নয় এখানে! এ ভাবেই পথচলতি মানুষদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল ক্রয়ডন বেঙ্গলি কানেকশান, বছর তিনেক আগে। প্রতুলবাবুর গানই যেন এদের জাতীয় সঙ্গীত— বাংলায় হাসি বাংলায় ভাসি বাংলায় জেগে রই। শুধুমাত্র বাংলারই জন্য বাংলা গান-ভাষা-কথকতা-নাচের জন্য এই দূরতর দ্বীপে রচনা হয়েছিল বাংলা স্টেজের। আম আঁটির সেই ভেঁপুখানা কখন যে ডাক দিল টেমসের তীর জুড়ে বাঙালিদের, সে হিসেব আর কে রেখেছিল? তাই তো উপচে পড়ে আনন্দধারা দেবীর আগমনের আকাঙ্খায়। |
|
এ বারে এই প্রথম ক্রয়ডন বেঙ্গলি কনেকশানের মহালয়া সেলিব্রেশন। মা আসছেন আগমনী হয়ে সেই শহরে যে শহর জানে আমাদের প্রথম অনেক কিছুই— কলকাতা নয, ক্রয়ডনে। দু’ই শহরই যে আমাদের বড় প্রিয়— এক শহর আছে আমাদের মনের মণিকোঠায় শিকড় ধরে টান দিলে হৃদপিন্ডে টান পড়ে, আর অন্যটি, যেখানে প্রতি নিয়ত মিশছি আমরা জল হাওয়া মাটির সঙ্গে।
অভিরাজ আর সুদীপ্তা শরতের মানে বোঝে না। ওরা আলোর পাহাড় দেখেনি, শুকতারা-আনন্দমেলা পড়েনি, শারদীয়া কিশোরভারতীর কথা এদের অজানা! কিন্ত রোজ স্কুলের পরে মহড়া দেয় ‘শরত্ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি’র। ওদের মিষ্টি গলার আওয়াজ সাত সমুদ্র তেরশো নদী পেরিয়ে হয়ত মিলে যায় গঙ্গার আকাশসীমায়! তিন বছরের আদুরী আত্রেয়ী-অনুষ্কা আর সম্প্রীত ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানের সঙ্গে নেচে ওঠে। ওদের পায়ের টলমলে নুপূর আলোর ঝালর হয়ে দূর প্রবাসে এনে দেয় শরতের স্পিরিট। পুজোর গন্ধ ভাসে ছোট্ট আদৃতা আর রিতিকা-সস্মিত-শ্রেয়নের কোরাসে। শরণ্যা আর সোহমও বাদ থাকে না— ওরা সবে ‘টিনস’-এ পা দিয়েছে। সোহমের স্যাক্সোফোন ঘোষণা করে ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে’ আর শরণ্যার পায়ের নুপূরে আলোর বেণুর বাজার মহালয়া লেখা হয়। |
|
মা আসছেন। স্থলপদ্ম-শিউলি-অপরাজিতার বদলে ধীরে ধীরে বাগান জুড়ে ফুটেছে ক্রিসান্থিমাম, কার্নেশান আরও অনেক রং-বেরঙের ফুল। কলাগাছের বদলে ঝাউগাছ, মঙ্গল ঘটে সশীষ ডাবের বদলে আফ্রিক্যান কোকোনাট, আমশাকের বদলে অন্য কোনও নাম-না-জানা পাতার সমারোহ আর গঙ্গাজলের বদলে টেমস ওয়াটার। কিন্তু শান্তির মন্ত্র তো সর্বজনীন। তাই আনন্দময়ীর আগমনের কথা লেখা হচ্ছে সুদূর বিদেশে মহালয়ার অনুষ্ঠানে। প্রার্থনাটুকু একই—
আঁধার থেকে আলোয়, মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে চল। |
|
|
|
|
|
|