স্পঞ্জ আয়রনের জন্য চুরি চাষের জল, শুকোচ্ছে খাল-বিল
চাষের জল কিনে নিচ্ছে স্পঞ্জ আয়রন কারখানা। চাষি যা দাম দেন, তার চেয়ে ঢের বেশি জলের দর দিচ্ছে কারখানার মালিক, তাই আপত্তি করছেন না বাঁকুড়ার সাব-মার্সিবল পাম্পের মালিকরাও। মাটির তলা থেকে তোলা জল চাষের খেতে না গিয়ে ভরা হচ্ছে ট্যাঙ্কারে। এক ঘণ্টা জল টেনে ভরে যাচ্ছে দু’-দু’টো ট্যাঙ্কার।
রাজ্য জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের হিসেবে, এক টন স্পঞ্জ আয়রন উৎপাদন করতে প্রায় তিন টন জল লাগে। একটি কারখানার কর্তৃপক্ষের হিসেব, প্রতিদিন জল লাগে গড়ে ৫-৬ লক্ষ লিটার। কারখানাগুলির এই জল পাওয়ার কথা বৃষ্টির জল ধরে রেখে এবং পুকুর কেটে। সাব-মার্সিবল পাম্প ব্যবহার করার কথাই নয় বাঁকুড়ার বড়জোড়ায় অবশ্য দেখা যাচ্ছে অন্য চিত্র। বড়জোড়া পঞ্চায়েতের দুই প্রাক্তন প্রধান তথা পঞ্চায়েতের বর্তমান তৃণমূল সদস্য অলোক মুখোপাধ্যায় ও টিঙ্কু মণ্ডলের অভিযোগ, “এলাকার দু’টি স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় সাব-মার্সিবলের মাধ্যমে মাটির তলার জল তোলা হয়। আমরা অতীতে দু’টি কারখানার বিরুদ্ধেই একাধিক বার আন্দোলনে নেমেছি। এখন ওরা চাষের সাব-মার্সিবল থেকেও জল কিনে নিচ্ছে।”
সাব-মার্সিবল পাম্পের সাহায্যে স্পঞ্জ আয়রন কারখানার জন্য তুলে নেওয়া
হচ্ছে জল। বড়জোড়ার হাট-আশুরিয়া গ্রামে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।
কী বলছে প্রশাসন? রাজ্যের জলসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রের বক্তব্য, “জল চুরি হচ্ছে। তবে তা আটকানোর মতো বড় পরিকাঠামো আমাদের নেই।”
আর পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার বলছেন, “নজরদারি রয়েছে। ধরতে পারলে জরিমানা করা হচ্ছে।” আর বড়জোড়ার বিডিও ইস্তেয়াক আহমেদ খান বলেন, “চাষের জন্য সাব-মার্সিবলের জল অন্য কাজে ব্যবহার বেআইনি। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখব।”
কিন্তু নজরদারির কোনও চিহ্ন দেখা গেল না বড়জোড়া সদরের অদূরে হাটআশুরিয়ায়। সেখানে কৃষিজমি লাগোয়া এলাকাগুলিতে কয়েকশো মিটারের মধ্যেই একাধিক সাব-মার্সিবল পাম্প রয়েছে। কিছু জলের ট্যাঙ্কারকে দেখা গেল, সেখানে গিয়ে সরাসরি পাম্পে পাইপ লাগিয়ে জল ভরতে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্যাঙ্কার চালক-খালাসির দাবি, তাঁরা একটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার জন্য জল নিচ্ছেন। এক ট্যাঙ্কার জলের দাম ৫০০-৬০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। নাম না-জানানোর শর্তে এক সাব-মার্সিবল পাম্পের মালিক জানালেন, চাষিদের জমিতে এক ঘণ্টা জল দিলে কমবেশি ১০০ টাকা পান। এক ঘণ্টায় গোটা দু’য়েক স্পঞ্জ আয়রন কারখানার ট্যাঙ্কারে জল ভরা সম্ভব। তাতে মেলে ১,২০০ টাকা।
বড়জোড়ার একটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, ট্যাঙ্কার থেকে জল ঢালা হচ্ছে কারখানার পুকুরে। ওই জল এল কোথা থেকে? কারখানার কর্ণধার অরুণ অগ্রবালের দাবি, ওই ট্যাঙ্কার পঞ্চায়েত সমিতির। অন্য একটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার জেনারেল ম্যানেজার জগদীশরাজ ভেইলও দাবি করেন, “বৃষ্টির জল জমিয়ে ও পঞ্চায়েত সমিতির কাছ থেকে কেনা জলেই কারখানা চলে।”
বড়জোড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের কাজল পোড়েল, এবং সদ্য প্রাক্তন সভাপতি সিপিএমের যদুনাথ রায় অবশ্য সে দাবি খারিজ করে দিয়েছেন। যদুনাথবাবু বলেন, “জলের ট্যাঙ্কার সমিতি পাঠায় না। পাইপের মাধ্যমে স্পঞ্জ আয়রন-সহ এলকার ১৪টি কারখানাকে দৈনিক গড়ে ৭০০-৮০০ কিউবিক লিটার জল দেওয়া হয়।” তা হলে স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় ট্যাঙ্কারের জল আসছে কোথা থেকে?
বাঁকুড়ার স্পঞ্জ আয়রন কারখানা মাটির তলার জল চুরি করছে, তো পুরুলিয়ায় তারা নদী, পুকুরের জল চুরি করছে বলে অভিযোগ। নিতুড়িয়া, সাঁতুড়ি ও পাড়া ব্লকে সাতটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার কয়েকটি পাঞ্চেত জলাধারের কাছের মহেশ নদীঘাট এলাকায় পাম্প-লাগানো ট্যাঙ্কার নিয়ে গিয়ে জল চুরি করে, জানাচ্ছেন বাসিন্দারা। দামোদর নদের অন্যত্র, ছোট নদী বা জোড়ে, এমনকী পরিত্যক্ত কয়লা খাদানে সাব-মার্সিবল পাম্প বসিয়ে জল তোলার অভিযোগও রয়েছে।
গত অক্টোবরে বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনের একটি যৌথ প্রতিনিধি দল বাঁকুড়া সদর লাগোয়া কারখানা পরিদর্শন করে রিপোর্ট দেয়। তাতে বলা হয়, কারখানার চৌহদ্দির ভিতর ৭৯টি কুয়ো খুঁড়ে ভূগর্ভের জল তোলা হয়। লাগোয়া প্রায় ৪০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকার পুকুর, খাল-বিল থেকেও জল তুলে আনা হচ্ছে।
জলচুরির কারখানা
কারখানার পাশে হরিয়ালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মন্দোদরী ঘোষ বলেন, “বিশেষ করে গরমকালে কারখানার লোকজন এসে দাঁড়িয়ে পুকুর খালি করে নিয়ে যায়। এক ফোঁটা জল পাই না আমরা।” আর এক লাগোয়া গ্রাম পাঞ্জার বাসিন্দা অসিত ঘোষের আক্ষেপ, বছর আটেক আগে তাঁর সাত বিঘা জমি ছিল তিন ফসলি।
এখন ধান হয় দু’বিঘাতে। বাকি জমি পড়ে রয়েছে। তাঁর অভিযোগ, “এলাকায় স্পঞ্জ আয়রন কারখানা চালু হওয়ার পরে পর্যাপ্ত সেচের জল পাই না। চাষ হবে কোথা থেকে?” কারখানা কর্তৃপক্ষ অবৈধ ভাবে জল তোলার অভিযোগ না মানলেও বাঁকুড়ার জেলাশাসক বিজয় ভারতী জানান, তদন্ত চলছে।
ছবিটা অন্য রকম নয় বর্ধমানেও। দুর্গাপুর ও কাঁকসায় স্পঞ্জ আয়রন কারখানার সংখ্যা প্রায় ১৫টি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কাঁকসার বামুনাড়া শিল্পতালুকে কয়েকটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা উৎপাদনের জন্য মাটির নীচ থেকে বিপুল পরিমাণ জল তুলে নেওয়ায় গ্রীষ্মে এলাকায় পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দেয়।
একই অভিযোগ শোনা গিয়েছে দুর্গাপুরের রাতুরিয়া-অঙ্গদপুর শিল্পতালুক, কমলপুর শিল্পতালুক এলাকায়। ‘স্টেট ওয়াটার ইনভেস্টিগেশন ডিরেক্টরেট’ (সুইড)-এর বর্ধমান কার্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্গাপুর, কাঁকসার মতো এলাকায় মাটির নীচ থেকে জল তোলায় বাধা নেই। তবে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জল একটি নির্দিষ্ট গভীরতা থেকে তোলার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ খরচ বাঁচাতে কিছু কারখানা অগভীর জলস্তর থেকে জল তোলাতেই সমস্যা দেখা দেয়। স্পঞ্জ আয়রন কারখানা মালিকরা অবশ্য নিয়ম মেনে কারখানা চালানোর দাবিই করেছেন।
রাজ্যের অধিকাংশ স্পঞ্জ আয়রন কারখানাই অনুমতি পেয়েছে বাম আমলে। সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্রের বক্তব্য, “যখন টের পেলাম কী ভয়ঙ্কর সর্বনাশ হচ্ছে, তখন আর কারখানাগুলোকে বাধা দেওয়ার উপায় নেই। এখন আমরা বিরোধিতা করছি।”

সহ প্রতিবেদন: সুব্রত সীট ও শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.